#প্রশ্ন_রয়ে_যায়
"There are more things in heaven and earth Horatio, than are dreamt of in your philosophy." ---হ্যামলেট , উইলিয়াম শেক্সপীয়র ।
নিশির ডাকের ব্যাপারটা পড়েছি অনেক , শুনেছি আরও বেশি । সেই ডাকেই কিনা , আজও জানিনা , আমার জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল জলপাইগুড়িতে থাকতে , ২০০০ কিংবা ২০০১ সালে । পাশের বাড়ির বড়দা জ্যেঠু মারা গেছেন রাত ন'টা নাগাদ , আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে । আমাদের মাষকলাইবাড়ি শ্মশানে ঢুকতে ঢুকতে রাত একটা বাজলো । তখনও ইলেকট্রিক চুল্লি চালু হয়নি । কাঠের ঘরের লোককে ডেকে এনে সৎকারের সব আয়োজন শেষ হতে হতে দু'টো হয়ে গেল । শ্মশানে শুতে নেই , তাই পাড়ার সবাই গল্পগুজবে ডুবে গেলাম । একটু 'বাইরে' যাওয়ার প্রয়োজন ছিল । কাঠের ঘরটার পিছনে এলাম । এটা বসার ছাউনিটা থেকে একটু দূরে , এবং বলা বাহুল্য এদিকে আলো নেই । শুনেছি , এখান থেকে কবরখানা শুরু , শেষ অনেকটা দূরে । এই জায়গাটায় নাকি মূলত সদ্যোজাতদের সমাধিস্থ করা হয় । তো , কাজ মিটে গেলে ভাবলাম একটু ঘুরে আসি । আকাশে তো চাঁদ আছে , যদিও মেঘের সাথে মাঝেমধ্যেই লুকোচুরি খেলছে , তবুও একেবারে অন্ধকার নয় চারপাশটা । এদিকটায় সাপখোপের ভয়ে দিনের বেলাতেও কেউ বড় একটা আসেনা । আমিও যে কেন এলাম তার উত্তর নেই আমার কাছে । বাবা কতগুলো বিষয়ে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে ছোটবেলায় খুব কড়া ছিলেন । আঠারো বছর বয়সের আগে আমি শ্মশান যাওয়ার অনুমতি পাইনি । একবার , পাড়ার একজন গত হওয়ার পর বায়না করার মত করে বলেছিলাম --- সবাই তো যাচ্ছে । আমিও যাই না ! বাবা খুব বিরক্ত হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন --- এটা কোনও উৎসব নয় , যে লাফাতে লাফাতে যোগ দিতে যেতে হবে । সময় হোক , তারপর যাবি । খুব , দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি প্রথমবার শ্মশানে যাওয়ার অনুমতি পেলাম আমার এক ক্লাসমেট আত্মহত্যা করার পর । সেই অভিজ্ঞতা বড় মর্মান্তিক । তিন-চার দিন খেতে-ঘুমোতে পারিনি । ঘুমের মধ্যে থেকে থেকেই ভয় পেয়ে জেগে উঠে বাবাকে জাপটে ধরতাম । কাজেই , বলা বাহুল্য আমি খুব সাহসী মানুষ নই । কিন্তু সেদিন যে কী হল !
আমি হাঁটছি তো হাঁটছিই । পাশেই কুলকুল করে বয়ে চলেছে করলা নদী । উঁচু নীচু ঢিবি , মানে কবর পেরিয়ে , ভালই লাগছিল হাঁটতে । মোটেও ভয় করছিল না । কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল । মাথাটা পালকের মত হালকা লাগছিল , যেন কারও হাতছানিতে আরও আরও দূরে চলে যাচ্ছিলাম । একটা আকর্ষণ কাজ করছিল , সেটা কিসের বুঝিনি । হঠাৎ কয়েকটা কুকুর চিৎকার করে তেড়ে আসায় যেন আমার হুঁশ ফিরল । নিজেই খুব অবাক হয়ে দেখলাম , শ্মশান ছাড়িয়ে বহু দূরে চলে এসেছি । চারদিকে , যতদূর চোখ যায় , কেউ নেই , অন্ধকারে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো ছাড়া । সত্যি বলতে কী , এবার বেশ ভয় লাগলো । যতটা সম্ভব পা চালিয়ে ফিরে এসে দেখি , আমাকে কোত্থাও খুঁজে না পেয়ে পাড়ার সবার একেবারে উৎকণ্ঠায় শেষ অবস্থা ! একে শ্মশান , তার উপরে রাতদুপুরে হঠাৎ গায়েব ! চুপচাপ ছাউনির নীচে এসে বসার পরেই শুরু হল প্রশ্নবাণ । একটু পরে আমাদের তখনকার বাড়ির সামনের টুটুলদা ঝাড়া আধঘণ্টা ধরে , কুড়ি-পঁচিশ জনের সামনেই , ওই ভোর রাতেই, আমাকে তুমুল ঝাড়ল(আজ দীপাবলির দিনে দাদার বাড়িতে কালীপুজো হচ্ছে , কাল সকালে প্রতিবারের মত পাড়ার সকলে সুস্বাদু খিচুড়ি ভোগ খেতে যাবেন ।) ! সবার বিরক্ত চোখ তখন আমার দিকে ! রাগ হয়নি , খুব ভাল লেগেছিল । এখানে আমাকে অত আন্তরিকভাবে বকা দেওয়ার মত লোক নেই । আমি নিজেও বুঝিনি আর কাউকে বোঝাতেও পারিনি , সেদিন আমি কিসের টানে , কোথায় , কেনই বা যাচ্ছিলাম । শুধু টুটুলদা সবটা শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল , কিন্তু কেন , তা বলেনি ।
সেদিন আরও একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছিল । তখন তিনটে-সওয়া তিনটে হবে । আমরা শ্মশানের সামনের রাস্তায় বসে আছি । হঠাৎ দেখি শুনশান রাস্তায় জগা মামার মত একটা লোক আমাদের বাড়ির দিক থেকে এদিকেই আসছে । পাশ থেকে বাবানদা বলল --- এ কী রে ! কে আসতেসে রে ! ভূত না জগা মামা ! কথাটা বলার সঙ্গত কারণ আছে । জগা মামা , জ্যেঠুর প্রিয় শ্যালক থাকেন ডালখোলায় । তাঁকে মৃত্যু সংবাদ দেওয়া হয়েছে রাত দশটা নাগাদ । কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জলপাইগুড়ি এসে পড়া প্রায় অসম্ভব । কিন্তু ওই যে বলেনা , ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় । জগা মামার কাছ থেকে আমরা যে গল্প শুনলাম, তা-ও কম রোমহর্ষক নয় । খবর পেয়েই জগা মামা হাতের কাছে যা টাকা পয়সা ছিল , নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন । সৌভাগ্যবশত বড় রাস্তায় এসে একটা ট্রাক পেয়ে যান , যেটি গোশালা মোড় হয়ে যাবে । উনি সেখানে নেমেছেন , তারপর সুহৃদ লেনের বাড়ি হয়ে আলো ফুটবার আগেই শ্মশানে । জ্যেঠুর নশ্বর শরীরটা বোধহয় সেদিন জগা মামার হাতের নিম আর চন্দন কাঠের অঞ্জলির জন্যই অপেক্ষা করছিল । সব অঙ্ক মেলানো যায়না , সব অঙ্ক মেলাতে নেই ।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.