ট্রিপল
টি --- টি , টিম্বার আর টোব্যাকো জলপাইগুড়ি জেলা তথা
সমগ্র উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির অভিজ্ঞান ছিল একসময় । সে রাম নেই , সেই অযোধ্যাও
আর নেই । নেই নগদের বদলে পারিশ্রমিক এবং বিনিময় মূল্য হিসেবে টি-টোকেনের ব্যবহার ।
এখন টিমটিম করে ধুঁকতে ধুঁকতে কয়েকটি চা বাগান টিকে আছে শুধু । তারই মধ্যে একটি, জলপাইগুড়ি
শহরের উপকণ্ঠে করলা ভ্যালি চা বাগানে ঘুরতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হল , তাতে উইলিয়াম শেক্সপীয়রের
‘হ্যামলেট’ নাটকের সেই জগদ্বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ছিল --- “There are more things
in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy.” “দুনিয়ায় কত
আছে দেখবার / কত কী জানার , কত কী শেখার” ভেবে, অনেকটা গুগাবাবার মতই পৌঁছে গিয়েছিলাম
করলা ভ্যালিতে । যতদূর দু’চোখ যায় , পাহাড়ের কোলে ততদূরই শুধু ঢেউ খেলানো চা গাছের
সবুজ পাতার সমারোহের নয়নাভিরাম দৃশ্য তো খুব পরিচিত , খুব চেনা । চা গাছের বিজ্ঞানসম্মত
নাম ক্যামেলিয়া সিনেনসিস । ‘ক্যামেলিয়া’ শব্দটি এসেছে জীববিজ্ঞানী জোসেফ ক্যামেলের
নাম থেকে । যদিও চা গাছ আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাঁর নয় । আর ‘সিনেনসিস’ কথাটার মানে, যা
চিন থেকে এসেছে । করোনা-কালে পাঠক এবার ভেবে দেখতে পারেন , চা খাওয়া বাদ দেবেন কিনা
! উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন টি-এস্টেটগুলি দার্জিলিং , জলপাইগুড়ি , কোচবিহার , কিসানগঞ্জ
এবং উত্তর দিনাজপুরে ছড়িয়ে রয়েছে । শিলিগুড়ি চা-নিলাম কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী দার্জিলিঙের
পাহাড়ি এলাকা , তরাই , ডুয়ার্সে অন্তত সাড়ে চারশো চা-বাগান রয়েছে । উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি
এলাকাকে তাই চা-বাগানের দেশ বললেও অত্যুক্তি হয়না । নবীনতম চা বাগান বলতে যে চিনচুলা
চা বাগান , রায়মাটাং চা বাগান এবং কালচিনি চা বাগানের নাম আসবে , সেগুলিও বয়সের দিক
থেকে বাহাত্তুরে । উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় চা-বাগান সামসিং টি-এস্টেট (১২৫৬.৬০হেক্টর)
। ইতিহাস বলে উত্তরবঙ্গে চা চাষ শুরু হয় অন্তত দেড়শ বছর আগে , পরাধীন ভারতে । ১৮৪০
সাল নাগাদ দার্জিলিং এবং সন্নিহিত এলাকায় চা চাষের প্রমাণ পাওয়া যায় । ছোট চা-বাগানগুলি
সমতলে ছড়িয়ে রয়েছে , করলা ভ্যালি তার অন্যতম । পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই ধরণের ছোট চা-বাগানের
সংখ্যা উত্তরবঙ্গে প্রায় ত্রিশ হাজার । সাধারণত এক একর জমিতে ছ’হাজার চারা লাগানো যায়
, যা থেকে উৎপাদিত চা পাতার পরিমাণ দশ হাজার কেজির মত । স্বাদে ও গন্ধে দার্জিলিং চায়ের
খ্যাতি ভুবনবিদিত । চা উৎপাদনের নিরিখেও সবচেয়ে এগিয়ে ডুয়ার্স অঞ্চল ।
এই ইতিহাস ও প্রাকৃতিক শোভা কমবেশি আমাদের
সকলেরই জানা এবং চেনা । কিন্তু যেটা ততটা চেনা নয় , তা হল চা গাছের ফুল । নভেম্বর মাস
থেকে শুরু করে গোটা শীতকালটা ডুয়ার্স , বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলগুলি সূর্যমুখী ফুলে ছেয়ে
থাকে । মনে হয় যেন আগুন লেগেছে পাহাড়ে , পাকদণ্ডী
পথের দু’পাশে । এই সময়ে করলা ভ্যালি চা বাগানে গিয়ে দেখলাম , গোটা চা বাগান ফুলে ফুলে
ছেয়ে রয়েছে । প্রজাপতি এসে বসেছে চা ফুলের ওপরে । উপর থেকে চা গাছগুলি দেখলে কিচ্ছুটি
বোঝার উপায় নেই । কিন্তু একটু ভাল করে ঠাহর করলেই দেখা যায় , চা গাছগুলির একটু নীচের
দিকে , ঠাসবুনট সবুজ চা পাতা আর লিকলিকে ডালপালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ফুলগুলি ।
সবুজে সবুজ চা বাগানের পটভূমিতে , সাদা পাপড়ি আর হলুদ পরাগরেণুর ফুলগুলির রূপ যেন ঠিকরে
বেরোচ্ছে ।
আমার অবাক হওয়ার পালা তখনও কিছুটা বাকি
ছিল । দেখছিলাম স্থানীয় বেশ কয়েকজন আদিবাসী মহিলা আর ছোট ছোট মেয়েরা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ
ভর্তি করে ফুল সংগ্রহ করছেন বাগানে ঢুকে গিয়ে । কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম --- ফুলগুলি কী কাজে লাগবে ? উত্তরে ওঁরা জানালেন
, অত্যন্ত সুস্বাদু এই ফুল দিয়ে রান্নার সময়ে নানা রকম পদ তৈরি হবে । সরলভাবে চা ফুলের
একটা ছোট ক্যারিব্যাগ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন --- “বাড়িতে নিয়ে যান , খেয়ে দেখবেন
।“ এ কথা বলেই , নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে আবার কাজে মন দিলেন । আর আমি ভাবলাম
, ক-ত অজানা রে !
চা-ফুল খেয়েছেন কখনও ? না খেয়ে থাকলে
, ফুল কাপ চা আপনি এখনও খাননি !






























