আয়া সেন্টার থেকে ওনাকে পাঠানো হয়েছিল । শয্যাশায়ী মাকে দেখেই বলে উঠলেন - পড়া পেশেন্ট আমি ধরব না । আমার শরীরে কুলাবে না । বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন । ফিরেও এলেন ঘণ্টাখানেক পর । সেন্টার ফের ওনাকেই পাঠিয়েছে, অন্য লোক নেই । বললেন আমার হাতে হাতে একটু ধরতে হবে । ধরলাম । সন্ধ্যাবেলায় চলে যাওয়ার আগে বললেন - মা যেন বিছানার ধারে চলে না আসে , একটু দেখো । এই পেশেন্ট যদি খাট থেকে পড়ে যায়, তাহলে কিন্তু ওনারও শাস্তি, তোমাদেরও । পড়ে থাকা যে কী শাস্তি তুমি বুঝবেনা বাবা । এক কথায় দু'কথায় নিজের প্রসঙ্গও এসে পড়ল । বললেন - স্বামী ষোলো বছর ধরে নিরুদ্দেশ (তবুও সিঁথিতে সিঁদুর , কপালেও)। দুই ছেলে , একজন আন্দামানে থাকে , আরেকজন কল্যানীতে । দুজনই নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত, কেউই আমাকে দেখে না । বেঁচে থাকতে হবে তো , তাই এই বয়সেও আয়ার কাজ করি । বাড়ি ভাড়া দিতে হয় মাসে তিন হাজার টাকা । এখন বলো তো, আয়ার কাজ করে যা পাই , সেটুকু পেটকে দেব, না বাড়িওয়ালাকে ? অসুখবিসুখ হলে চিকিতসা করার পয়সাও থাকেনা । বেঁচে থাকার অনেক জ্বালা , বুঝলে ।
করোনা ভাইরাস এসে যৌনকর্মীদের ভাতে মেরেছে । আদিম রিপুর দংশনের চেয়েও মানুষের প্রাণের মায়া বেশি । আরও অনেকের মত দিনবাজারের মানসীর লোকের দয়ায় পেট ভরছে । সরকারের থেকেও রেশন মিলছে , কিন্তু সংসারে নগদ টাকার চাহিদা কী এসবে মেটে ? সংসার ! হাসি পায় মানসীর । সংসারের করার স্বপ্নে বিভোর হয়েই মালবাজারের বাড়ি থেকে বিপ্লবের সাথে পালিয়েছিল সে । দু'দিন ফুর্তির পরে বিপ্লব তাকে অন্য লোকের হাতে বেচে দিয়েছে । প্রথমটায় বিপ্লবের এই আচমকা পরিবর্তন বিশ্বাসই করতে পারেনি সে । যতদিনে বিশ্বাস হল , ততদিনে বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়ে এই পাড়ায় ঠাঁই পেয়েছে ।
খিদে বড় বালাই , দেড় বছর ধরে লকডাউনের ধাক্কা মানসীর জীবনেও ভালভাবেই এসে লেগেছে । এমন একটা দুনিয়ায় তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে সমাজ, যে বিকল্প জীবিকা খোঁজার পথটাও খুব কঠিন । ইদানীং খদ্দের আসছে , তবে হাতে গোনা । মানসী তাই এই পরিস্থিতির ওপর , সমাজ-সংসারের ওপর বেজায় খাপ্পা । তার মনে প্রতিশোধস্পৃহা জেগে ওঠে । ইচ্ছা করে গোটা পুরুষ জাতটাকে উচিত শিক্ষা দিতে । বছর কুড়ি আগে , স্কুলে পড়তে কাগজে একটা নষ্ট মেয়ের কথা পড়েছিল মানসী । ঘটনাটা অভিনব । মেয়েটি এইচ আই ভি পজিটিভ ছিল । কন্ডোম ছাড়া একাধিক যৌন সংসর্গে যে এইডস , সিফিলিস , গনোরিয়ার মত অসুখ অনিবার্য, মানসী সেটা জানত । ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস , জীবন বিজ্ঞানে মাধ্যমিকে লেটার মার্কস ছিল তার । আজ লোকে সে কথা শুনলে হাসবে । তো, সেই মেয়েটা একটা অদ্ভুত খেলা খেলেছিল সমাজের সাথে । যে সমাজ , যে পুরুষ তাকে এই মারণ ব্যাধিতে আক্রান্ত করেছে , তাঁদের সঙ্গে সঙ্গমের সময় সে নিজের অসুখের কথা বেমালুম লুকিয়ে ফেলত । সেই সময়েও কন্ডোম নিয়ে এত সচেতন ছিলনা মানুষ । ফলে ওই একজন মেয়ের থেকেই বহু পুরুষ এইচ আই ভি - তে আক্রান্ত হয় । ব্যাপারটা এত অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল যে পুলিশি তদন্ত শুরু হয় । দেখা যায় আক্রান্তদের সকলের যৌনপল্লীতে যাতায়াত ছিল । তদন্ত আরও এগোতে দেখা যায় , আক্রান্তরা সবাই কোনও না কোনও সময়ে ওই মেয়েটির কাছে গিয়েছে । শেষে মেয়েটিকে জেরা করে গোটা ঘটনাটা জানা যায় ।
যদি বিপ্লবকে হাতের কাছে পাওয়া যেত , ভাবে মানসী , আর নিষ্ফল আক্রোশে ফুঁসতে থাকে । লাইনের অন্য মেয়েরা খেয়াল করেনা , মানসীর চোয়াল ক্রমশ শক্ত হচ্ছে ।
অনিরুদ্ধ , মানে আমাদের অনির বাবা ডব্লিউ বি সি এস অফিসার ছিলেন , মা স্কুল
শিক্ষিকা । অনিও লেখাপড়ায় ভালই ছিল , কিন্তু বেশ কয়েকবার স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা
দিয়েও চাকরি পায়নি । অনির ছোট থেকেই ছবি তোলার হাত ভাল , তাই ওর মা ওকে একটা ডি এস
এল আর ক্যামেরা কিনে দিয়েছেন । অনি কিছুকাল শখে ছবি তোলার পর ঠিক করে নিয়েছে ও কমার্শিয়াল
ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করবে । পরিচিত মহলে বলা আছে , বিয়েবাড়ি , কোম্পানির মিটিং ,
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছবি তোলার জন্য অনি এখন নিয়মিত ডাক পায় ।
একজন পরিচিতের মাধ্যমেই প্রস্তাবটা এল ।
শব ব্যবচ্ছেদের , গোদা বাংলায় বললে ময়না তদন্তের ভিডিওগ্রাফি করতে হবে । মোটা টাকা
পাওয়া যাবে । একটা খুনের কেসে কোর্ট ময়না তদন্তের ভিডিও কোর্টে পেশ করতে বলেছে । তাই
ফরেন্সিক তদন্তের খুঁটিনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ক্যামেরায় ধরে রাখতে হবে । অনি ভাবল,
এ আর কী এমন শক্ত কাজ , পরিশ্রম কম , পারিশ্রমিক বেশি । যেটা অনি ভাবল না , সেটা হল
পারিশ্রমিকটা কেন বেশি । তো, একদিন সকালবেলা অনির ডাক পড়ল মর্গে । ট্রাইপড মানে স্ট্যান্ড
আর ক্যামেরা নিয়ে যথাসময়ে অনি হাজির । উদ্দেশ্য সব সেট করে , ক্যামেরা চালু করে অন্য
দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকবে । কিন্তু কাটাছেঁড়া শুরু হওয়ার পর বুঝল , কাজটা এতটা সহজ
হবে না । দু’মিনিট পরপর নির্দেশ আসছে ফোকাস পরিবর্তন করবার , জুম ইন করবার , এমনকি
একেবারে কাছে এসে ছবি তোলার । কিছুক্ষণ এভাবে কাজ চলার পরেই অনির মুখে যেন অন্নপ্রাশনের
ভাত উঠে এল । কিন্তু পুলিশ কেস , ও সব জেনেবুঝেই কাজটা নিয়েছে । শেষ করতেই হবে , পালাবার
উপায় নেই । এইজন্যই বোধহয় ডোম-সহ উপস্থিত সকলে আকণ্ঠ মদ খেয়ে আছে , মনে হল অনির । সেদিন
মুখে রুমাল বেঁধে , বমি চাপতে চাপতে কোনওমতে কাজটা শেষ করে , অনি টলতে টলতে বাড়ি ফিরে
এসেছিল । দু’দিন খেতে পারেনি , রাতে দুঃস্বপ্নে বারবার ঘুম ভেঙে গেছে । এক সপ্তাহ বাদে
কোনওমতে নিজেকে সামলে , নাকে খত দিয়ে অনি প্রতিজ্ঞা করেছে , আর কোনওদিন ময়না তদন্তের
ভিডিওগ্রাফি করবে না ।
অভিজ্ঞতাটা এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে শোনা । বিভাগীয় প্রধান দুপুরের দিকে একটা লেখার দায়িত্ব দিয়েছেন , পরদিন সকালে অফিসে ঢুকেই লেখা জমা দিতে হবে । বন্ধুটি খুব খেটেখুটে লেখাটা ওয়ার্ড ফাইলে, ডি ড্রাইভে সেভ করে সন্ধে সাড়ে ছ'টা নাগাদ অফিস ছাড়ল । কাগজের অফিসে এরপর নাইট শিফটের সাংবাদিকরা ঢুকবেন । প্রত্যেকের কম্পিউটার আলাদা । প্রত্যেকের পাসওয়ার্ড আলাদা , সে ছাড়া অন্য কেউ কম্পিউটার চালাতেই পারবেনা ।
পরদিন অফিসে বন্ধুটি ঢোকার পর বস লেখাটা ওনার কম্পিউটারে পাঠিয়ে দিতে বললেন । পা দোলাতে দোলাতে বন্ধুটি নির্দিষ্ট ফোল্ডারটি খোলার পরেই হাঁ , লেখাটা নেই । নেই মানে একেবারে নেই , ভ্যানিশ ! এদিকে লেখাটার কোনও কপিও করা নেই । হতভম্ব হয়ে বন্ধুটি টলতে টলতে গিয়ে বসকে গোটা ঘটনাটা বলল । এবং ভয়ঙ্কর ঝাড় , থুড়ি বকুনি খেল । তার কারণও আছে । লেখাটা রবিবারের ক্রোড়পত্রে যাবে , সেই লেখা এবং পেজ লে আউট তৈরি করে জমা দিতে হয় বৃহস্পতিবার বিকেলের মধ্যে । এবং ঘটনাচক্রে সেই দিনটাও ছিল বৃহস্পতিবার । যে বস সহজে রাগেন না , তিনি কঠোর গলায় বললেন , আজ লেখা জমা দিয়ে অফিস ছাড়বে । কথাটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন । কারণ লেখাটা জমা দিতে হবে , সেদিনের রুটিন কাজগুলো করার সাথে সাথে । যাদের অভিজ্ঞতা আছে , তাঁরা বুঝবেন কাজটা কী অসম্ভব চাপের ।
যাইহোক , বন্ধুটি সেদিন আবার যারপরনাই পরিশ্রম করে আবার লেখাটা তৈরি করল , এবং অপেক্ষমাণ বসকে লেখাটা জমা দিল । তারপর দু'টো প্রতিজ্ঞা করল , এরপর থেকে পেন ড্রাইভে প্রতিটি লেখার কপি রাখবে , আর দুই এই কাগজের অফিসের চাকরিটা ছাড়বে । তারপর কোথা থেকে কী হইয়া গেল , বন্ধুটির আর চাকরিটা ছাড়া হয়ে উঠল না । তার হারিয়ে যাওয়া লেখাটা কোন মন্দার বোস ভ্যানিশ করল তাও জানল না । শুধু বসের সমবয়স্ক এক কলমচির কোনও লেখা পরবর্তী তিন বছর ওই কাগজে দেখা যায়নি । লেখা মানে সিগনেচারড কলাম , যাতে লেখকের নাম থাকে । বন্ধুটির সন্দেহ হওয়ায় বছর দুয়েক পর সে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল , ওই শাস্তিপ্রাপ্ত কলমচি লেখাটা হারানোর সন্ধেয় নাইট শিফটে ছিলেন !
পাড়ার প্রায় সকলে বিনুদিকে অপছন্দ করে । এর পিছনে দু'টো কারণ আছে --- এক, বিনুদির কটু কথা বলার অভ্যেস , আর দুই, ছেলেমেয়েদের মেধা নিয়ে তাঁর মাত্রাতিরিক্ত গর্ব করে বেড়ানো । একটা মানুষের বিরক্তির কারণ , আরেকটা আড়ালে হাসি-ঠাট্টার । বিনুদির দুই মেয়ে , এক ছেলে । তারা সকলেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ছাত্রছাত্রী আর সত্যিই মেধাবী । এবং সেই কারণেই মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যারপরনাই উন্নাসিক । পাড়ার সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে তাদের মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব চলে আসে । এইসব কারণে ওঁদের সংসারটা পাড়ার মধ্যে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত । সময়ের দাবি মেনে একে একে বিনুদির , মানে আমাদের বিনু জ্যেঠিমার, সব ছেলেমেয়েদের মস্ত বড় বড় সব ঘরে বিয়ে হল । আমরা কবজি ডুবিয়ে দু'তিন বছর পরপর নেমন্তন্ন খেলাম । অভাবে স্বভাব নষ্ট । অভাব না থাকলে, এ সমাজে চলার পথে হোঁচট না খেলে আর স্বভাব নিয়ে কে ভাবে ? ওঁরাও স্বভাব নিয়ে ভাবেননি । হয়ত ভেবেছিলেন , জীবনটা একই খাতে বইবে সারাজীবন । কিন্তু তা তো হয়না , ওঁদের ক্ষেত্রেও হলনা । সৃষ্টি কর্তার হাতে যে খাতা থাকে , তাতে প্রত্যেকের জীবনের পৃষ্ঠায় দু'টো স্তম্ভ থাকে , একটা প্রাপ্তির , আরেকটা অপ্রাপ্তির । কর্তামশাই স্বয়ং সেই তালিকায় নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রাখেন , নির্দেশও করেন-- দাঁড়িপাল্লার কাঁটার মত । আমরা যত বড় হতে লাগলাম , সেই সূচকটা তত স্পষ্ট ভাবে সকলের চোখে পড়তে লাগল । ওঁদের সমাজবিচ্ছিন্নতা ব্যুমেরাং হয়ে ওঁদের দিকেই ফিরে এল , যেমন আসে । মেয়েরা বিয়ের পর চোখে পড়ার মত যোগাযোগ কমিয়ে দিতে দিতে বন্ধ করে দিল । অঙ্কের স্কুল শিক্ষক ছেলে আরও উন্নতি করে অধ্যাপক হয়ে বদলি নিয়ে অন্য জেলায় চলে গেল । কিন্তু চলে যাওয়ার আগে ওঁদের বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা হতে হতে যে হলনা , সেটা জানল মাত্র পাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা । বিনু জ্যেঠির বৌমা উচ্চশিক্ষিতা । ফলে ওঁর দাপুটে ব্যক্তিত্বের কারণে দু'জনের কলহ বাধল এবং বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেটা একেবারে বাড়িতে কাক বসতে পারেনা , এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল । তিক্ততা চরম পর্যায়ে পৌঁছলে, একদিন ওঁর ছেলের বৌ কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন । শেষ মুহূর্তে তাঁর হাত ধরে টেনে যিনি পরিবারটির সম্মান রক্ষা করলেন , পাশের বাড়ির সেই প্রতিবেশীর সাথেও তাঁদের দিন শুরু হত তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে অকারণ নিয়মিত তর্কাতর্কিতে । পাকাপাকি ভাবে ছেলেমেয়েদের সাথেও ওঁদের আর কোনও যোগাযোগ রইল না । জ্যেঠুর অবসর গ্রহণের পরে ওঁরা দু'জন পরিবার ও সমাজ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রইলেন পাড়ায় । ওঁরা স্বভাবে কিছুটা ভাঙলেন এরপর , কিন্তু মচকালেন না । যে ছেলেমেয়ে কোনও খোঁজখবর রাখে না , তাঁদের নিয়ে ওঁদের ফলাও করে গল্প করার স্বভাব, ওঁদের আড়ালে হাসির খোরাক করে তুলল । আর কিছু মানুষ সহজাত সহানুভূতিশীলতার কারণে শত অপমান এবং বিরক্তি সত্ত্বেও বিপদেআপদে ওঁদের পাশে এসে দাঁড়াতে ভুললেন না । বরং নিজেদের সামাজিক কর্তব্য বলে মনে করলেন , যেমনটা আর পাঁচ জনে করেন ।
তারপর , আমরা বুড়ো হয়েছি । ওঁরা নবতিপর- অশীতিপর হয়ে মাস দুয়েকের ব্যবধানে দেহ রেখেছেন বছরখানেক আগে । কারও মুখাগ্নিই ছেলে করেননি , এক নিকটাত্মীয় করেছেন । অতঃপর এই জগৎ-সংসারে এই দু'টি অদরকারি মানুষ যে বাড়িটিতে থাকতেন , অনিবার্যভাবে সেটির বিক্রির প্রশ্ন এসেছে, এবং কিমাশ্চর্যম অতঃপরম, তখন ঠিক তিন ছেলেমেয়ের মাথা এক হয়েছে ! সব দেখেশুনে পাড়ার প্রবীণেরা কেউ কেউ সবেগে দু'দিকে মাথা নাড়িয়ে, মুখে চুকচুক শব্দ করে বললেন --- এমনটাই তো হওয়ার ছিল । আর কেউ কেউ এই ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীরবে ।
মেয়েদের অনেকগুলো জীবন । বাপের বাড়ির জীবন - শ্বশুরবাড়ির জীবন, বিয়ের আগের জীবন-বিয়ের পরের জীবন , চল্লিশের আগের জীবন এবং চল্লিশের পরের জীবন । নিজেকে দেখতে সুন্দর লাগুক , সবাই ফিরে ফিরে দেখুক , কে না চায় । মেয়েরাও চায় , ছেলেরাও চায় । কিন্তু মেয়েদের চাওয়াটা বিয়ের পরে, ব্যতিক্রম ছাড়া পাল্টে যায় সন্তান ধারণ করতে গিয়ে । এ নিয়ে মেয়েদের মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে । তাকে কী আর আগের মত সুন্দর লাগছে , এখনও কী ছেলেরা তাকে দেখে মুগ্ধ হয় --- এই কথাটা চল্লিশ এবং তদূর্ধ্বরা মনে মনে বারবার যাচাই করে নেন । এই প্রক্রিয়ার সাথে আত্মবিশ্বাসের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে । আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না , ভালবাসায় ভোলাব --- কথাটা শুনতে ভাল , বাস্তবে নয় । আজকাল কাজটা তুলনামূলক ভাবে সহজ হয়ে গেছে । ফেসবুকে , ইন্সটাগ্রামে , হোয়াটসঅ্যাপে ছবি আপলোড করলেই হল । তারপর শুধু দেখার অপেক্ষা কত জনে 'লাইক' করে , কত জনে ভালবাসার রক্তিম চিহ্ন এঁকে দেয় ! তিলোত্তমাও কোনও ব্যতিক্রমী চরিত্রের মেয়ে নয় । স্কুলে পড়ার সময় থেকে বিয়ের আগে অবধি অনেক ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে । ডাকসাইটে সুন্দরী , বিদুষী , রূপচর্চায় পারদর্শী তিলোত্তমা সেইসব প্রস্তাব ফুঁৎকারে উড়িয়ে অদ্ভুত আনন্দ পেয়েছে । তিলোত্তমা এখনও সাজতে ভালবাসে । তার বিশ্বাস , নিজেকে সুন্দর রাখলে মন ভাল থাকে । তিলোত্তমা এখন এক ষোড়শীর জননী , তৎসত্ত্বেও শারীরচর্চা এবং ডায়েটিং করে পঁচিশ বছর আগের খুকি-খুকি , কচি-কচি ভাবটা অনেকটা ধরে রাখতে পেরেছে । বাড়ির সবচেয়ে প্রিয় আসবাব , পূর্ণদৈর্ঘ্যের আয়নাটার সামনে ঘরের দরজা বন্ধ করে দাঁড়ালে , তিলোত্তমা সেটা নিজেই ভাল বোঝে । তিলোত্তমা এখন হাওড়ার একটা গার্লস কলেজে পড়ায় , আর অবসরে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের প্রচুর ছবি দেয় , প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পোশাকে , বিভিন্ন ভঙ্গিমায় । অচেনা , অল্প চেনা তো বটেই , পুরনো বন্ধুরাও ওর রূপের তারিফ করে । দু'দিন আগে টপ আর হট প্যান্ট পরে , একটু সাজুগুজু করে, ছবি আপলোড করার পরে ওর পরিচিত মহলে ঝড় বয়ে গেছে । অধিকাংশই যে বাঁকা হাসি হেসেছে , সেটা তিলোত্তমা জানে এবং থোড়াই কেয়ার করে । কলেজে দু'টো ক্লাসের ফাঁকে , টিচার্স রুমে বসে ও ফেসবুক মেসেঞ্জার চেক করছিল । পরপর স্তুতি , দু'একটা কুপ্রস্তাব পেরিয়ে এসে একটা মেসেজে হঠাৎ চোখ আটকে গেল তিলোত্তমার । পাঠিয়েছে অনিমেষ বসু । কোন অনিমেষ ? তিলোত্তমার ফ্রেন্ডলিস্টে অনেকগুলো অনিমেষ আছে । অন্যগুলোর মত মার্ক অ্যাজ রেড করতে গিয়েও থমকে গেল তিলোত্তমা । মেসেজটা খুলল । আর তারপরেই মনটা ভাল হয়ে গেল ওর । যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়ার সময় অনি ওর ব্যাচমেট ছিল । একটু ব্যথা কেসও হয়েছিল । তারপর বহুদিন যোগাযোগ নেই । সেই অনি বাংলা হরফে সুন্দর করে লিখেছে --- আমার যৌবনের বৃন্দাবন কলকাতায় তো আমার সঙ্গে থাকলি না , অন্তত বার্ধক্যের বারানসী জলপাইগুড়িতে আমার কাছাকাছি থাকিস । আমি ধুপগুড়ি কলেজে পড়াই এখন । লেখার শেষে দু'টো দাঁত বের করা হাসির ইমোজি ।
ঠোঁটে স্মিত হাসি ধরে রেখে আরেকবার আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিলোত্তমা মিত্র । এখনও তাঁকে বিগতযৌবনা বলা যায় না তাহলে !