"গল্প" লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
"গল্প" লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২২

স্বপ্নে প্রতিদিন । কল্যাণী মিত্র ঘোষ । প্রেমের গল্প । ভালবাসার গল্প ।

আমি এখন একটা প্রজাপতি হয়ে অরণ্যের লিভিং রুমে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করছি। আমি রোজ রাতেই এরকম কিছু একটা হয়ে যাই, হয় হামিং বার্ড, নয় রোলি পোলি অথবা হানি বি। এই আমেরিকার পোকা মাকড় গুলো বাচ্চাদের খুব প্রিয়, কেউ এদের মারে না, আলতো করে হাতে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাদের চাল চলন দেখে। তাই আমিও যখন খুশী এই সব রূপ ধারণ করি, খুন হওয়ার কোনো আশঙ্কাই থাকে না। আমার নাম সিক্তা।

আর আমাকে প্রজাপতি করে তুলেছে তো অরণ্যই, কি সুন্দর সুন্দর কথা দিয়ে ও আমাকে একটু একটু করে পরমা রূপবতী করে তুলেছে। নিজেকে আয়নায় দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাই, কোথায় সৌন্দর্য্য? এতো এক সাধারণ মেয়ে! কিন্তু ও বলে, আমি পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে ও গোলাপের গন্ধ পায়, আমার টেক্সট মেসেজ ওকে মাতাল করে তোলে, আর যেদিন আমরা একান্তে দেখা করি সেদিন ও বুভুক্ষুর মতো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পরে একটু একটু করে শুষে নেয় আমার ভেতরে ওর জন্য, শুধু ওরই জন্য জেগে ওঠা টই টুম্বুর প্রেম। মেঘের ভেলায় চেপে ভেসে যাই দুজনে। বৃষ্টি নামে, প্রবল।
ওর সঙ্গে আলাপ আমার ইউনিভার্সিটি থেকে। আমি এখনও রিসার্চ করছি, ও এখন অবশ্য একটা চাকরীতে ঢুকেছে, পাশের শহরেই। ওর সঙ্গে যেদিন আমার দেখা সেদিন প্রবল তুষারপাত আমেরিকার পূর্ব রাজ্যে। আমি সবে এসেছি, রকম সকম কিছুই জানিনা, একটা স্নো বুট পর্য্যন্ত ছিলনা। ও তখন ল্যাব থেকে বেরিয়ে আমাকে দেখেই কেমন স্ট্যাচু হয়ে গেল। আমারও বুকটা হঠাৎ ধড়াস করে উঠলো। টানটান, মেদহীন লম্বা চেহারা আর মাথায় কাঁচা পাকা চুল। পরে জেনেছি ওটা জেনেটিক, অনেক আগেই নাকি ওর চুল পাকতে শুরু করেছিল। ওর ঠোঁটের কাছে কেমন একটা চুম্বকের আকর্ষণ। চোখ নামিয়ে নিই। অসম্ভব মায়াবী গলায় আহ্বান আসে,
"আপনি বাঙালী? একবার যেন দেখলাম মনে হলো ক্যাফেটেরিয়ায়? কবে এসেছেন? কোথায় উঠেছেন? আপনি তো সেরকম প্রস্তুত হয়ে আসেন নি দেখছি। চলুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি আপনাকে।"
এবার কপালকুণ্ডলা নবকুমারের পশ্চাদ্ধাধাবন করিল।
দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেল। অরণ্যকে ছাড়া আমি চোখে অন্ধকার দেখি। ও ই আমাকে ইউনিভার্সিটির কাছে একটা স্টুডিওর খোঁজ পাইয়ে দিয়েছে। সস্তায় ভদ্র পাড়ায়। ও এদেশে সেই ছাত্রাবস্থায় এসেছিল, আর ফেরেনি। মাস তিনেক পর জানলাম ও বিবাহিত। ও ই জানালো। কিন্তু অসম্ভব অসুখী, ওর বউ এর সাংঘাতিক সন্দেহবাতিক আর সেই থেকে গার্হস্থ্য হিংসা। ও বেচারা বাড়িতে নিঃশ্বাস নিতে পারেনা, একমাত্র কাজ ই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অমায়িক, মৃদুভাষী, সুপুরুষ, দয়ালু মানুষটার দুর্গতিতে কোমল হৃদয়া আমি শোকাকুল হয়ে পড়ি।
"সেকি? এদেশেও এ রকম একটা সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে আছো? ডিভোর্স দাও না কেন? এখানে তো শুনেছি সব কিছুই খুব সহজ, এবং সবাই ন্যায় বিচার পায়। তুমিও শান্তিতে থাকো আর ও ও ভালো থাকুক।"
"দুর, যা সব সময় খবরে পড়ো তা ঠিক নয়। অনেক সমস্যা। আমার এত দিনের উপার্জনের অনেকটা বেরিয়ে যাবে, তাছাড়া আরো নানান হ্যাপা।"
"তাহলে মানিয়ে গুছিয়ে চললেই তো পারো!"
"আর তা পারিনা, এখন তোমার চোখে আমার সর্বনাশ দেখেছি যে!"
ওর সেই অসম্ভব আকর্ষণীয় ঠোঁট দুটো আস্তে আস্তে আমার মুখের ওপর নেমে এসে আমার সমস্ত যুক্তির অবসান ঘটায়।
আমি মেনে নিই এই সম্পর্ক টা সেই সঙ্গে পড়াশুনোতেও মন দিই। এদেশে কেউ কারোর ব্যাপারে মাথা ঘামায় না, পরের স্বামী ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া টাইপের কোনো মন্তব্য ভেসে আসে না। কাজের জায়গায় আমরা যে যার নিজের গণ্ডির মধ্যে থাকি আর ব্যক্তিগত জীবনে অপার স্বাধীনতা। ইতিমধ্যে অরণ্য পাশের শহরের বায়োটেক কোম্পানীর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগে বেশ ভালো একটা চাকরি পেয়ে যায়। আমাদের দেখা করা একটু অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ও আর তেমন টেক্সট করেনা। আমার ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে। দু একবার ওকে মেসেজ করেছি, ও বলেছে,
"নতুন চাকরিতে নাভিঃশ্বাস উঠছে। বাড়িও চেঞ্জ করে অফিসের কাছাকাছি এসেছি। এছাড়া জানোই তো আমার ব্যক্তিগত সমস্যার কথা। খুব চাপে আছি, ডিপ্রেশনে। "
তা হবেও বা! তবু মন কেমন করে, এক লাইন টেক্সট করতে কি হয়! এর মধ্যে হঠাৎ একদিন শুভর সঙ্গে দেখা। আমি একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনছি। যাঁর গাড়ি উনি সস্ত্রীক ভারতে ফিরে যাচ্ছেন, সত্যিই নামমাত্র দামে উনি গাড়িটি বলতে গেলে "দিয়ে যাচ্ছেন"। ওনার অ্যাড দেখে আমি উত্তর দিতেই উনি আমাকে ফোন করলেন,
" তুমি নিয়ে যাও গাড়িটা, যত্নে রেখো। আমিও ছাত্র হয়েই এদেশে এসেছিলাম, এখন মেয়েও এদেশে চাকরিতে ঢুকেছে, আমরা বুড়োবুড়ি দেশে ফিরছি, হয়তো তিন মাস করে এখানে মেয়ের কাছে বেড়াতে আসবো। তোমার এখন সামনে বিরাট স্ট্রাগল, আমি যদি এটুকু সাহায্য করতে পারি তাহলে ভালো লাগবে। আমি অন্য কাউকে এটা দিচ্ছিনা, কাল চলে এসো, আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবে।"
কি আন্তরিক কণ্ঠস্বর, মনটা ভালো হয়ে গেলো। পরদিন ওনার বাড়ি গেলাম বাসে চেপে, আর ভাবতেই ভালো লাগছে যে ফিরবো আমার নিজস্ব বাহনে! গত তিনমাসে আমি ফাঁকে ফাঁকে গাড়ি চালানোর স্কুলে ভর্তি হয়ে হাত পাকিয়ে ফেলেছি। এদেশে ভীষণ কঠিন ফ্রী ওয়ে তে গাড়ি চালানো। খুব নার্ভাস লাগে, অবশ্য সেটা এড়াতে অনেক ঘুরপথেও যাওয়া যায়।
মিস্টার শর্মার ডোরবেল টা বাজাতে দরজা খুললো দেখি শুভ, আরে কি কান্ড! ও এনাকে চেনে নাকি? তাহলে তো দারুণ হবে। আমার সঙ্গে ও ফার্স্ট ইয়ারে পড়েছিল, তারপর আর আমাদের যোগাযোগ ছিলনা, শুনেছিলাম ও বিদেশে পড়তে চলে গেছে। শুভ হৈ হৈ করে উঠলো,
"আমি আঙ্কলের থেকে তোর নাম দেখেই বুঝেছি এই আমাদের সিক্তা, তারপর ফেসবুকে একবার তোর প্রোফাইল এ ঢুঁ মেরে শিওর হয়ে গেলাম। কি ভালো লাগছে রে তোকে দেখে!"
মিস্টার শর্মাও বেরিয়ে এলেন।
হিন্দীতে বললেন অনেক দিন ধরেই উনি শুভ কে চেনেন, আসলে এদেশে পুজো পার্বণ বা ঘরোয়া পার্টিতে গেলে পরিচয় হয়ে যায় আর সে থেকে অনেক সম্পর্ক প্রায় আত্মীয়তায় পর্যবসিত হয়। বিদেশে একা থাকা মানুষ গুলো খুঁজে নেয় প্রাণের দোসর। শুভ সেই থেকে ওনার ঘরের ছেলে হয়ে গেছে। উইকএন্ডে অনেক টা ড্রাইভ করে এসে দেখে যায় আঙ্কল আন্টি কে। ও একটুও বদলায় নি, সেই কথায় কথায় হা হা করে হাসি। আমিও নস্টালজিয়ায় ভেসে গেলাম।
শর্মা আন্টির হাতের রান্নার স্বাদই আলাদা। ওনারা নিরামিষ খান , মেনুতে ছিল আলু কা পরাঠা, ছোলে, রায়তা, চিলি পনীর আর গাজর কা হালওয়া, এলাহি কাণ্ড। আমি বহুদিন পর চেটে পুটে সব খেয়ে নিলাম। এরপর আঙ্কল বললেন,
"চলো, এবার আমার ছোট মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিই, আর তার আগে শেষ বারের মতো এক চক্কর দিয়ে আসি।"
টেস্ট ড্রাইভ, গাড়ি কেনার আগে এটা মাস্ট, কিন্তু আমার কোনো টেনশন ছিলনা, শুভ এনাদের চেনেন অতএব ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। নইলে অনেকেই দেখেছি লঝ্ঝড়ে গাড়ি বেমালুম গছিয়ে দেন ভুলভাল বিজ্ঞাপন দিয়ে। গ্যারাজে গিয়ে দেখলাম গাঢ় নীল রঙের একটা টয়োটা ক্যামরি, দেখেই ভালোবেসে ফেললাম, জলের দরে পাচ্ছি বলেই আমি কিনতে পারছি। খুব যত্নে রাখবো ওকে, শর্মা আঙ্কল কে বললামও সে কথা। এরপর আমরা চার জনে ঘুরে এলাম আধ ঘণ্টা একটা লেকের ধারে। এখন এ দিকে ফল কালার এসে গেছে, সবুজ গাছের পাতারা হলুদ, লাল, কমলা রং ধারণ করে নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। সে সব দেখতে দেখতে আমরা লেকের পাশেই ঘুরে নিলাম। বাড়ি এসে আঙ্কল শেষ বারের মতো গাড়িটার গায়ে হাত বুলিয়ে চাবিটা আমার হাতে তুলে দিলেন, আমারও বুকের কাছটা মুচড়ে উঠলো, আমি আলতো করে আঙ্কলের হাতের ওপর হাত রাখলাম। ব্যাংক ট্রান্সফার আগেই করে দিয়েছি। এবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবো। শুভ বলল,
"আর দু ঘন্টা এটা আঙ্কলের গ্যারাজেই থাক, চল তোকে আমার এক কলিগের বাড়ি নিয়ে যাই পাশের শহরে, পনেরো মিনিটের ড্রাইভ। তারপর আবার তোকে এখানে নামিয়ে দেবো তুই এখান থেকে ড্রাইভ করে ফিরে যাস। রাত অভি বাকি হ্যায় ইয়ার।"
ওর জোরাজুরিতে রাজি হয়ে গেলাম, আজ শনিবার, কাল সকালে ওঠার তাড়া নেই। আঙ্কলদের বাই বলে আমি শুভর ফোর্ড এক্সপ্লোরার এ উঠে বসলাম। গাড়িতে বাজছে রাহাত ফতে আলীর " ইয়ে যো হাল্কা হাল্কা সুরুর হ্যায়, ইয়ে তেরি নজর কা কসুর হ্যায় ..."
শুভ বকবক করেই চলে,
" চল দেখবি দারুণ ভালো লাগবে, হেব্বি আড্ডাবাজ মানুষ ওরা, আমার কম্পানী তে এই সবে জয়েন করেছে। স্বামী স্ত্রী একদম লাভ বার্ডস, নইলে অন্য বউ রা বরদের বন্ধুদের যখন তখন বাড়ি এসে আড্ডা মারা পছন্দ করে না। আমি বৌদি কে ফোনে তোর কথা বলতেই তোকে নিয়ে যেতে বললো।"
বলতে বলতে গাড়িটা একটা সুন্দর তিনতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। ভদ্রলোক তার মানে বেশ ভালো পোস্টেই কাজ করেন। শুভ জোরে জোরে বেল বাজাতে লাগলো, বোঝা গেল এ বাড়িতেও ওর অবাধ যাতায়াত।
দরজা খুলে দিলেন এক মিষ্টি মুখের মহিলা, পূর্ণ গর্ভবতী। হাসতে হাসতে ধমক দিলেন শুভ কে,
"এই অবস্থাতেও আমাকে দৌড় করালে তো? দাঁড়াও তোমার দাদা আসুক, তোমার কি অবস্থা করে দেখো!"
"সে কি, দাদা নেই?"
"আরে একটু বিরিয়ানী আনতে পাঠালাম, তুমি আসছো, সঙ্গে বান্ধবী, একটু ভালো মন্দ খাওয়াবো না? এসো ভাই বসো।"
আমরা কিচেনের লাগোয়া ফ্যামিলি রুমটায় গিয়ে বসলাম। মহিলার যেমন মিষ্টি চেহারা তেমনি সুন্দর ব্যবহার। এদিকে আমার আবার একটু টয়লেটে যাবার প্রয়োজন হয়ে পড়লো। গৃহকর্ত্রী কে জিজ্ঞেস করতেই উনি ঘরের অন্য প্রান্তটি দেখিয়ে দিলেন। শুভ বললো,
"বৌদি, তোমাকে দৌড় করিয়েছি, অতএব শাস্তি স্বরূপ আমি চার জনের কফি বানিয়ে আনছি, ইউ প্লীজ রিল্যাক্স।"
টয়লেট থেকেই শুনতে পেলাম সদর দরজার লক খুলে কেউ ঢুকলো। গৃহস্বামী এলেন বুঝি। মুখে চোখে একটু জল দিয়ে চুলটা ঠিক ঠাক করে নিলাম। সারাদিন টই টই, উফ্ শুভর পাল্লায় একবার পড়লে .....
একি! এ কার কণ্ঠস্বর! আস্তে করে দরজাটা খুলে দেখি এ যে আমার অরণ্য, আমার! সেই দীর্ঘদেহ, কাঁচাপাকা চুল, হন্তদন্ত হয়ে লিভিং রুমের দিকে গেল। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? তারপর হাতের ব্যাগ গুলো কিচেনের তাকে রেখেই ছুটে এলো মহিলার কাছে, তাকে এক হাতে জড়িয়ে গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো, যে ভাবে আমার ঠোঁট থেকে সব রস শুষে নিতো, ঠিক সেই ভাবে! আমি যন্ত্রচালিতের মতো এক পা এক পা করে আলো আঁধারিতে ওদের সোফার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি। স্থবির। অরণ্য মহিলার কানে কানে বলছে,
"মিসড্ ইউ।"
"খালি পাগলামো, এই আধ ঘণ্টায় ইউ মিসড্ মি? এমন মারবো না!"
"কখন মারবে? কি ভাবে মারবে? বলো না সোনা!"
চুমু খেতেই থাকে অরণ্য।
মহিলা বলেন, "ছাড়ো, শুভ কফি নিয়ে আসছে ...."
ঠিক এই সময় আমি একটু এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে অরণ্যর কাঁধে হাত রাখি, আর ও বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে পেছন ফিরে তাকায়, মুখ ফ্যাকাশে! আমি কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ওদের উল্টো দিকের সোফায় গিয়ে বসি, একটু হাসি। অরণ্যও হাসে। সম্পূর্ণ বিপরীত এই দুটো হাসি। আমার কান্না পায়, চীৎকার করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আমি হাসি।
শুভ কফি নিয়ে আসে।
"অরণ্য দা, এই আমার বন্ধু সিক্তা।"
সে রাতে আমি চেটেপুটে বিরিয়ানী খেয়ে বাড়ি এলাম নিজের টয়োটা ক্যামরি চালিয়ে। অরণ্য বেচারা বিরিয়ানী খেতেই পারলো না, বললো ওর মাথা ধরেছে। আহা রে। হয়তো এখন ও স্ত্রীর কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছে, অথবা চোখ বন্ধ করে আমার কথা ভাবছে আর শিউরে উঠছে! আমি এই বেলা প্রজাপতি হয়ে ওর ঠোঁটের সেই মারাত্মক খাঁজে গিয়ে বসি, ফিসফিস করে ডাকি,
"রণ, আমার রণ ..."
ও শুনতে পায়, কিন্তু সাড়া দিতে পারেনা, আমাকে ছুঁতে চায় কিন্তু দেখতে পায়না, আর আমি ডানা ফরফরিয়ে ওর আসে পাশে উড়ে বেড়াই। কাল যাবো একটা ঘাস ফড়িং হয়ে, রোজ যাবো, স্বপ্নে।
সমাপ্ত
কল্যানী মিত্র ঘোষ

httpssankhamanigoswami.xyz




প্রেমের গল্প বাংলা,প্রেমের গল্প প্রেমের গল্প,প্রেমের গল্প রোমান্টিক,প্রেমের গল্প কাহিনী,

প্রেমের গল্প ভালোবাসার গল্প, প্রেমের গল্প দুঃখের , প্রেমের গল্প কষ্টের , ভালবেসে একটি মেয়ের আঘাত পাওয়ার গল্প



রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২০

মাটির গন্ধ

 মাটির গন্ধ

 

                                         (১)

            গিটারটা মাথার ওপর দিয়ে খুলতে খুলতে সৌরীশ বলল --- “নাহ , উই আর মিসিং সামথিং ইয়ার ! হোয়ার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন , প্রবাল ?”

--- “ঈপ্সিতারা কমন রুমে গেছে । কিন্তু তুই জিমনাসিয়ামের বারান্দায় বসে , একা একা কাকে গান শোনাচ্ছিলি ?”

--- “বলছি , এই মিঠুন , ডান দিকে সর তো একটু । এখানে বসলে মেন গেটের দিকে নজর রাখা যাবে । মনীষা আসলে দেখতে পাব । এবার তোর কথার উত্তর দিই । ওখানে গিয়ে একা একা বসে গান গাইছিলাম , কারণ আমি একটু একা থাকতে চাইছিলাম । ডু ইউ নট থিঙ্ক , আমরা আজকাল বড় বেশি কথা বলছি , সরবে এবং নীরবে , ফোনে এবং ফেসবুকে ? এত কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে বড্ড হাঁপিয়ে উঠি । আজকাল সন্ধেবেলার দিকে কখনও কখনও রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম গিয়ে গর্ভগৃহের পিছনের দিকে চুপচাপ ঘণ্টাখানেক চোখ বন্ধ করে বসে থাকি । সন্ধ্যারতি হয়ে যাওয়ার পর , ওই যে পিন ড্রপ সাইলেন্স --- ওটা মন আর মগজের পক্ষে বড্ড আরামদায়ক , কপালে মায়ের হাত বোলানোর মতন । আচ্ছা মিঠুন , তোরও কী মনে হয় না , আমাদের বন্ধু-বান্ধবীদের চোখের তারাগুলো আজকাল কেমন অস্বাভাবিকরকম চঞ্চল ?”

--- “আমি তোর মত ভাবুক নই । আর তোর মত ইন্টেলেক্টও আমার চোয়ালে এসে জমা হয়নি , অতয়েব আমি ইন্টেলেকচুয়ালও নই । তবে হ্যাঁ , দ্য ফার্স্ট পার্ট অব ইওর স্পিচ ইজ কোয়ায়েট রেলেভ্যান্ট । ইয়েস , উই আর মিসিং সামথিং । কী যেন একটা , খুব কাছাকাছিই আছে , কিন্তু ধরতে পারছিনা , বুঝতে পারছিনা । মনের ভিতর কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা আছে আর  সেটাকে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মত খুঁজতে খুঁজতেই আইপডে শ’য়ে শ’য়ে গান শোনা , গার্লফ্রেন্ডের সাথে তিস্তার স্পারে বসা আর সারাদিন ধরে ঘরে-বাইরে প্রচুর অদরকারি কাজে ডুবে থাকা আছে । এই আমাদের কথাই ধর , দু’দিন বাদে থার্ড ইয়ারের রেজাল্ট বেরোবে , আস্তে আস্তে আমরা কাজের জগতে হারিয়ে যাব , হয়তো বা নিজের মধ্যে থেকেও হারিয়ে যাব । এ সি কলেজের আনাচকানাচে এভাবে মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ে বেড়ানোটাকে মিস করব ভীষণভাবে । অথচ দেখ , এখনও পর্যন্ত আমরা রিয়েলাইজই করে উঠতে পারছিনা , আল্টিমেট সুখটা ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে , কিসে পাওয়া যাবে !”

--- “ঠিক তাই ।“ মিঠুনের কথার সূত্র ধরে প্রবাল বলল --- “অ্যাপারেন্টলি আমাদের কোনও অভাব নেই । আমাদের বাবা-মা’দের যে প্রজন্ম তাঁরা এত নিরুদ্বেগে-নিশ্চিন্তে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পাননি , সেদিক থেকে তো আমরা সৌভাগ্যবান । অথচ বুকের ভিতর কখনও কখনও ডিপলি ফিল করি , কোথায় যেন একটা নোঙর ফেলা বাকি । বুকের ভেতর থেকে কে যেন মাঝরাতে ফিসফিস করে বলে যায় , এই বেলা খুঁজে নাও , এই জীবন থেকে পরিপূর্ণভাবে তুমি ঠিক কী চাও । জীবনটাকে তুমি চালাবে , না জীবন তোমাকে । রাশ তোমার হাতে থাকবে , নাকি জীবনের গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে , অসহায়ভাবে মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে থাকবে যে , যাক , জীবন যেমন চায় , যেদিকে চায় , আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাক । জীবন হোক বেলাগাম ।“  

--- “এই , আমরা বড্ড বেশি দার্শনিকের মত কথা বলছি । ছাড় তো । জাঁকিয়ে শীত পড়েছে কিন্তু আজ । টেম্পারেচার কততে নামল আজকে ? শিলিগুড়িতে তো চার না পাঁচ বলল খবরে ।“ উত্তর পাওয়ার অপেক্ষা না করেই মিঠুন আবার বলল --- “কালই তো বড়দিন । আচ্ছা , থার্টি ফার্স্টে পিকনিক করতে গেলে হয়না মূর্তি কিংবা রোহিণীতে ?” ওর গলায় আনন্দ মেশানো উত্তেজনার ছোঁয়া ।

--- “বাস পাওয়া যাবে ভেবেছিস ! কুট্টিরা কালীঝোরা যাবে বলে একমাস আগে থেকে কালুসাহেবের একটা বাস বুক করে রেখেছে । তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি সবকিছু অরগানাইজ করা যাবেনা । চাঁদা তোলার ব্যাপার আছে , মেয়েদের বাড়িতে কনভিন্স করানোর ব্যাপার আছে । তার চেয়ে বরং কাছেপিঠে কোথাও চল । লাল মন্দির গেলে হয়না ? নদী আছে , চা বাগান আছে , দারুণ জায়গা” --- বলল শুভার্থী । এতক্ষণ ও চুপচাপ বসে বাকিদের কথা শুনছিল ।

--- “ঠেলা ভাড়া করতে হবে , বাসনকোসন , চ্যালা কাঠ আর রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য । ঠেলাওয়ালা এই সময়ে সুযোগ বুঝে অনেক টাকা ভাড়া হাঁকবে । তাছাড়া যেতেও অনেক সময় লাগবে । তার চেয়ে বরং করলা ভ্যালি চা বাগানটা সিলেক্ট কর । কলেজের কাছেই হবে । আমরা সবাই সুবোধদার দোকানের সামনে সকালে মিট করব , তারপর একসঙ্গে যাব । এগ্রিড ?” বলল সৌরীশ ।

ওর অকাট্য যুক্তি মেনে নিয়ে সবাই মিলে করলা ভ্যালি চা বাগানেই পিকনিক করতে যাওয়া স্থির হল । কিছুক্ষণ পর নবনীতা , ঈপ্সিতা , মনামিরা কমনরুম থেকে ফিরলে ওদের সঙ্গে আলোচনা করে বাজেট আর মেনুও ঠিক হয়ে গেল । চাঁদা ও পিকনিক স্পট নিয়ে বান্ধবীরা ওদের সঙ্গে সহমত । কেবল একটাই শর্ত , রান্নার দায়িত্ব একা মেয়েরা নেবে না , ছেলেদেরও হাত লাগাতে হবে । ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কেবল ফটো তুললেই চলবে না । হাত পুড়িয়ে রাঁধতে হবে না , এই-ই ঢের । এই শর্তে কেউ অরাজি হয় ! ছেলেরা সমস্বরে বলল --- তথাস্তু !

                                            (২)   

      ঠিক ছিল সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে সবাই কলেজের মেন গেটের সামনে সাইকেলে পৌঁছবে । রান্নার জিনিসপত্র কলেজপাড়ার এক বন্ধুর বাড়িতে রাখা থাকবে । একটা ঠেলা জোগাড় করা হয়েছে । ঠেলাওয়ালা নয় , ওরাই কলেজ থেকে করলা ভ্যালি পর্যন্ত সেটাকে ঠেলেঠুলে চালিয়ে নিয়ে যাবে ঠিক হয়েছে । ওইটুকু তো মাত্র পথ । কথামত আগে-পরে সবাই পৌঁছে গেল । স্নান করে আসতে হয়েছে বলে সবাই অল্পবিস্তর কাঁপছে । কাঁধ উঁচু করে হাতের চেটো ঘষছে । চারদিকে ঘন কুয়াশা । কথা বলতে গেলেই মুখ দিয়ে সবার ধোঁয়ামত বেরোচ্ছে । সবার মুখে হাসি । ওরা অপেক্ষা করছে উত্তমের জন্য । ওদের মুরগির ফার্ম আছে । মাংসের ব্যবস্থাটা ও-ই করবে । ছাড়িয়ে-কাটিয়ে আনতে হবে বলেই সম্ভবত ওর একটু দেরী হচ্ছে । সব রেডি , ও আসলেই সবাই বেরিয়ে পড়বে ।

       সাড়ে আটটা নাগাদ একটা বাজারের ব্যাগ সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে উত্তম যখন হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হল , তখনও আকাশের মুখ ভার । দেখেই বোঝা যায় , আজ রোদ ওঠা মুশকিল আছে । পিকনিকের পক্ষে একেবারে আদর্শ দিন ! একটু পরে কুয়াশা কেটে যাবে কিন্তু হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডাটা কমবে না । রান্না বসিয়ে , সেই আগুনেই হাত সেঁকে নেওয়া যাবে । পরপর গোল করে সাজিয়ে উনুন তৈরি করার জন্য মেন গেটের উল্টোদিকে সুবোধদার দোকানের সামনে কিছু ইট এনে রাখা ছিল । দোকানটা জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি মেন রোড থেকে একটু নীচুতে । ঢাল বেয়ে নামতে গিয়ে হিম ভেজা ঘাসে দু’একজনের পা পিছলে গেল । মনীষা গলা ছেড়ে গাইছে --- “দো নয়না অর এক কাহানি / থোড়া সা বাদল , থোড়া সা পানি / অর এক কাহানি ।” আরতি মুখার্জির এই গানটা সত্যিই মনির গলায় খোলে ভাল , মনে মনে ভাবল সৌরীশ । মিঠুন ডাকল --- “এই শুভার্থী , এদিকে আয় , জলের ড্রামটা একটু ধর , ঠেলায় তুলে দিই । সবাই যখন এসে গেছে , তখন আর দেরী করে লাভ নেই । ওখানে গিয়ে মাংসটা ধোওয়া আছে । তাছাড়া মাঝেমাঝেই যেরকম দমকা হাওয়া দিচ্ছে , তাতে উনুন জ্বালিয়ে রাখা কঠিন হবে । আয় আয় , দেরী করিস না । অ্যাই দীপঙ্কর , একদম ইয়ার ফোন বের করবি না । আরে ইয়ার , দিনটা এনজয় কর , গাছের থেকে নীচের শুকনো পাতাগুলোতে টুপটুপ করে ঝরে পড়া শিশিরের শব্দ শোন । আজকে প্লিজ কানে ওটা গুঁজে রাখিস না । জিনিসটা বড্ড ইরিটেটিং বাড়ির বাইরে এলে ।“ দীপঙ্কর জিন্সের প্যান্টের ডান পকেট থেকে ইয়ার ফোনটা বের করতে গিয়েও মিঠুনের ধমক খেয়ে বাধ্য ছেলের মত সেটা আবার স্বস্থানে ঢুকিয়ে রাখল !

         ওরা রওনা দিল । ঠেলা সঙ্গে থাকবে , তাই সবাইকে সাইকেল নিয়ে হেঁটে যেতে হবে । উত্তম আস্তে আস্তে ঠেলার প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে । সৌরীশ গিটার বাজিয়ে কবীর সুমনের একটা গান ধরল --- ‘কতটা পথ পেরোলে, তবে পথিক বলা যায়’ । সৌরীশ গলা ছেড়ে গাইছে , সবাই চুপ । দু’একজন মাঝে মাঝে ঠোঁট নাড়িয়ে কথাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে শুধু । মোহিতনগরের দিক থেকে শহরে কাজের খোঁজে ঢুকছে যে লোকগুলো , তারা সৌরীশের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে যাচ্ছে । জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি রুটের বাসের জানলা দিয়ে মুখ বার করে অনেকে কৌতূহলী চোখে দেখছে ছেলেমেয়েগুলোকে ।সৌরীশ সে সব কিছুই খেয়াল করছে না । নিজের মনে গাইতে শুরু করলে , বিশ্বচরাচরের সব কিছু ওর চোখের সামনে থেকে মুছে যায় ।

          একটু পরে , ওরা যখন ঢুকছে করলা ভ্যালি চা বাগানে , তখন কুয়াশা অনেকটাই কেটেছে । হাওয়ার দাপটও কমেছে খানিকটা । সামনের দিকে আদিগন্ত তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায় । চারদিকে উঁচু-নীচু ঢেউ খেলানো চা বাগান ধীরে ধীরে নেমে গেছে করলা নদীর খাতের দিকে । নদী পেরিয়ে ওপারে আবার সবুজ ঢেউয়ের বিস্তার । মাঝখান দিয়ে চা বাগানের বুক চিরে এঁকেবেঁকে অল্প গভীর খাতের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে করলা নদী । নদীর দু’পাশে বেশ খানিকটা জায়গা পর্যন্ত বালি জমে আছে । বর্ষাকালে নদী এই পর্যন্ত উঠে আসে দিব্যি বোঝা যায়  বালির ওপর পড়ে থাকা বড় গাছের শুকনো ডাল আর ছোট ছোট বোল্ডার দেখলে । নদীর তীরে বালির ওপর এখানেই ওদের রান্নার ব্যবস্থা হবে । দু’পাশে চা গাছের সারি , আর তার মাঝে চাপা রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে ওরা দেখল , প্রায় প্রতিটি চা পাতার বেঁকে আসা শীর্ষবিন্দুটিতে মুক্তোর মত জমে রয়েছে শিশিরের কণা । নদীর দু’পাশেই চা বাগানের মধ্যে কিছুটা দূরে দূরে চা গাছগুলির মাথায় ছাতা ধরার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে বড় বড় মোটা গুঁড়ির গাছ ।

        প্রবালের ফটোগ্রাফির শখ আছে , ওর ডি এস এল আর ক্যামেরা সচল হয়ে উঠেছে । তাই ও একটু একটু করে পিছিয়ে পড়ছে ওদের দল থেকে । সেটা লক্ষ্য করে ঈপ্সিতা গলা তুলে ওকে ডাকল --- অ্যাই প্রবাল , তাড়াতাড়ি আয় , পরে ছবি তুলিস । আয় এখন একসঙ্গে যাই । আজ বিকেল পর্যন্ত আমরা সবাই একসাথে থাকব , একা ঘোরাঘুরি চলবে না ।

--- “যথা আজ্ঞা ম্যাডাম !” প্রবাল পিঠের ব্যাগে ক্যামেরা পুরে ফেলল । নদীর পাড়ে পৌঁছে একটু পরিষ্কার মত একটা জায়গা বেছে নিয়ে রান্নার তোড়জোড় শুরু হল । ওরা তিনটে দলে ভাগ হয়ে গেল । এক দল গেল নদীর পাড়ে মাংস ধুতে , একদল ইট সাজিয়ে পাশাপাশি দু’টো উনুন তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । আর মেয়েরা বালির ওপর চাদর পেতে বসলো ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করতে । সঙ্গে ফ্লাস্কে করে সবার জন্য চা বানিয়ে এনেছে নবনীতা । সবার জন্য ডিম-পাউরুটি-মাখন আর কলা আনা হয়েছে । রান্নাটা চাপিয়ে দিয়েই জঠরাগ্নি কিছুটা প্রশমনের ব্যবস্থা করতে হবে । কেউই অত সকালে খেয়ে আসেনি , তাই সকলের পেটেই ছুঁচো দৌড়চ্ছে !

 

                                              (৩)

       “এই সোডিয়াম , কেরোসিন তেলের ড্রামটা নিয়ে আয় ঠেলার উপর থেকে, কাঠগুলো ভাল জ্বলছে না , আরেকটু তেল ঢালতে হবে” -- হাঁক পাড়ল প্রবাল । ফাঁকা জায়গা বলে ওর কথার প্রতিধ্বনি হল কিছুটা । সেই শব্দে কাছেপিঠের গাছ থেকে এক ঝাঁক কিচিরমিচির করতে থাকা পাখি উড়ে গেল ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে । জায়গাটা এতই নিস্তব্ধ যে কথা বললেই তা কয়েকগুণ জোরে বাজছে কানে । তাই কারওই কথা বলতে বিশেষ ইচ্ছে করছিল না । নবনীতাও কপট রাগ দেখিয়ে , ঠোঁট ফুলিয়ে , ধুপ ধুপ করে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে প্রবালকে তেলটা দিয়ে এসে চটি পেতে বসল ওদের পাশে । নদীর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নবনীতার তোম্বা হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল শুভার্থী । নবনীতা ‘সোডিয়াম’ সম্বোধনটাতে খুব চটে যায় , আর সেই কারণেই সবাই ওকে আরও বেশি করে খ্যাপায় ! ‘সোডিয়াম’ নাম কেন ? কারণ ইংরেজিতে নবনীতার নামের বানান শুরু হয় এন এ(Na) দিয়ে , যেটা সোডিয়ামের রাসায়নিক চিহ্ন । প্রবালটা একা উনুন নিয়ে পড়েছে , চাল ধুতে হবে , রান্না চাপাতে হবে একে একে । এবার ওঠা দরকার , হাতে হাতে কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার বুঝছে সবাই , কিন্তু এই অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা থেকে চোখ সরিয়ে কারওই আর উঠতে ইচ্ছে করছে না । স্তব্ধতা ভেঙে সৌরীশ হঠাৎ বলে উঠল --- “কী অদ্ভুত ব্যাপার না ,আমরা কিন্তু অনেকক্ষণ একসাথে চুপ করে বসে আছি । হল কী রে আমাদের !” হক কথা , ওরা নিজেরাও বহু চেষ্টাতে মনে করতে পারবে না , শেষ কবে একসাথে বসে স্তব্ধতার গান শুনেছে । আসলে , এটা এই জায়গাটার গুণ । এই বিরাট উন্মুক্ত প্রান্তরে ওরা সবাই আত্মস্থ হয়ে রয়েছে । মুখে কথা আসবে কী করে ? মনে মনে সবাই ভাবছিল , এতদিন এখানে আসিনি কেন । এই যে অনির্বচনীয় আনন্দের অনুভূতি , তা মনকে মাতিয়ে তোলে না , বরং শান্ত করে , একটা অভিনব কোমল পরশ বুলিয়ে দেয় । এই স্পর্শ সবার কাছেই অনাস্বাদিত । এই যে সামনে , চারপাশে , দিগন্তবিস্তৃত অফুরন্ত সৌন্দর্য , এই যে এঁকেবেঁকে, ছোট ছোট রঙবেরঙের নানা আকারের পাথরের উপর দিয়ে কুল কুল করে বয়ে যাওয়া নদী , এই যে তাকে প্রহরীর মত ঘিরে থাকা চা-গাছগুলো , আর সেই ছোট ছোট সবুজ চা পাতারই রঙের ক-ত বৈচিত্র্য , পাতার ওপর মুক্তোর মত ঝিকমিক করতে থাকা জলকণা , আশপাশের বড় গাছগুলোতে নাম না জানা কত কত পাখির কত রকমের সুরেলা ডাক , আর সেই ডাকের অপূর্ব মাদকতা , এ তো চট করে ফুরোবার নয় , থেমে যাওয়ার নয় । প্রকৃতি যেন আজ সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত করেছে তার মাতৃরূপ ।

             উনুন এবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে । অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবাইকে উঠতেই হল । আলু-ফুলকপি কেটেকুটে আনাই হয়েছে , কলেজ পাড়ার বন্ধুটির বাড়িতে বসে মেয়েরা এসব করেছে কাল সন্ধেবেলায় । এতগুলো মানুষকে রান্না করে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে বলে ঈপ্সিতা –নবনীতারাও আজ যেন একটু বেশি বড় বড় ভাব করছে ! রান্নাবান্নার ব্যাপারটা যত এগোবে , ছেলেরা জানে , এই ভাব তত বাড়বে ! কিন্তু আজ আর এসব নিয়ে মেয়েদের কেউ ঘাঁটাবে না । দীপঙ্কর , ঈপ্সিতাকে শুধু বলতে গিয়েছিল , বকফুল আর চাটনিটা শেষে করার কথা । ওরা ওকে ব্যসন ফেটিয়ে দেওয়ার কথা বলাতে আমতা আমতা করছে দেখে মজা পেয়ে বাঁ হাতটা তুলে মিঠুন বলল --- “চিন্তা করিস না , আমি ওটা করে দেব । এবার আয় , সবাই ব্রেকফাস্টটা সেরে নিই । প্রায় সাড়ে দশটা বাজে ।“

    

                                               (৪)   

            খাওয়াদাওয়া শেষ হতে হতে প্রায় সওয়া তিনটে বাজল । ঘড়ির কাঁটা পাঁচটার ঘর পেরোলেই ঝুপ করে অন্ধকার নামবে , তাই ওরা সবাই মিলে এবার ঘুরতে বেরোল । কাছাকাছি একটা চায়ের কারখানা আছে , সেটা দেখে ওরা নদীর কোল ঘেঁষে হাঁটবে কিছু দূর অব্দি , এমনটাই ঠিক হয়েছে । এসব জায়গায় তো আর একা একা চট করে আসা হয়না , তাই যতটা পারা যায় সবাই ঘুরে দেখে নিতে চাইছে । স্থানীয় দু’জন লোক , ওরা যখন খাচ্ছিল এক পঙক্তিতে বসে , তখন দূরে বসে জুলুজুলু চোখে তাকিয়েছিল । ওদের ডেকে পেট পুরে খাইয়ে সঙ্গের জিনিসপত্র আর সাইকেল পাহারায় বসিয়ে আসা হয়েছে । এইসব আদিবাসীরা খুব বিশ্বাসী হয় , তাই জিনিসপত্র খোয়া যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই । হাঁটতে হাঁটতে সবাই রান্নার প্রশংসা করছে । করবেই , কারণ প্রত্যেকেই কব্জি ডুবিয়ে আঙুল চেটে খেয়েছে । মেয়েরা বাড়িতে কত রান্না করে , সবাই জানে ! কিন্তু আজকের পরীক্ষায় ওরা একেবারে ডিসটিঙ্কশন পেয়ে পাশ করেছে । সঠিক স্বাদ বজায় রেখে এতগুলো মানুষের জন্য রান্না করা কি চাট্টিখানি কথা ! আসলে মনটা আনন্দে থাকলে , তাজা থাকলে , সব কাজই ভালভাবে উতরে যায় । চায়ের কারখানায় কাণ্ড-কারখানা দেখে ওদের তাক লেগে গেল । এক জায়গায় ছোটখাটো একটা পাহাড়ের মত স্তূপ করে রাখা বাগান থেকে আনা চা পাতা , আর এক জায়গায় ওরা দেখল একটা কনভেয়ার বেল্টের উপর দিয়ে চা পাতা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটা বাক্স মতন যন্ত্রে । পাতাগুলো সেখান থেকে কুচিকুচি হয়ে বেরিয়ে আসছে । ওদের সবার গায়ে গরম জামা , সোয়েটার , চাদর । অথচ ওদের দেখে খারাপ লাগল , যারা কারখানায় কাজ করছে , তারা প্রত্যেকেই পাতলা-শতচ্ছিন্ন জামাকাপড় পরে রয়েছে । অথচ লোকগুলো এত পরিশ্রম আর কষ্টের মধ্যেও হাসতে ভোলেনি । কাজ করতে করতেই রসিকতা করছে পরস্পরের সাথে । সকালবেলা ঘুম ঘুম চোখে যে উষ্ণ তরলে সবাই সরু করে ঠোঁট ছোঁয়ায় , সেটা গৃহস্থের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার পথে যে কত মানুষের শ্রম লুকিয়ে থাকে !

            কারখানা থেকে বেরিয়ে ওরা নদীর ধারে বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় একটা সরু বাঁকে , নদীর জল একটু কম দেখে , নদী পেরিয়ে গেল ওপারে । বাঁ হাতে চটিজোড়া নিয়ে পায়ের পাতা ডোবা , হাড় হিম করা ঠাণ্ডা জলের মধ্যে দিয়ে নদী পেরোতে গিয়ে ওদের সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল । এ পাশটায় লোকজনের যাতায়াত আরও কম , তাই পাখির সমাবেশ আরও বেশি । চা-বাগানের মাঝে বড় গাছগুলিতে শ’য়ে শ’য়ে পাখির কলরবে জায়গাটা ভরে আছে । এত সুরেলা , এত মধুর সিম্ফনি ওরা কেউ আগে শোনেনি । প্রবাল চা-গাছগুলোর মাথায় বসে থাকা ছোট ছোট নানা রঙের পাখির ছবি তুলতে তুলতে ভাবছিল , প্রকৃতিতে যে এত রঙ আছে , রঙের এত বৈচিত্র্য আছে , তা-ই তো জানা ছিলনা এতদিন । সেই লাইনটা মনে পড়ে যায় --- দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া , ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া , একটি ধানের… , থুড়ি চা পাতার ওপর , একটি শিশিরবিন্দু !   

           এর মধ্যে কখন যে দিনের আলো নিভে এসেছে কেউই খেয়াল করেনি । এখনই কালো পর্দার মত অন্ধকার নেমে আসবে আর চা-গাছগুলোকে ঘিরে এল ই ডি আলোর মত থোকায় থোকায় জোনাকি জ্বলে উঠবে । এই জায়গাটা তখন সেজে উঠবে অন্য এক রূপে । দু’একটা জোনাকি ইতিমধ্যেই এদিক-ওদিক থেকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে । তার সঙ্গেই খুব মৃদু হলেও শুরু হয়েছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক । এবার ওদের ফিরতে হবে । আবার সেই বাগানের ঢাল বেয়ে নেমে আসা , আবার সেই নদী পেরনো । এপারে এসে ওরা বালির ওপরে চটি হাতে খালি পায়েই হাঁটছিল । ভিজে পায়ে চটি পরে বালির ওপর দিয়ে হাঁটা যায়না । টুকটাক কথা বলতে বলতে ওরা বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছে , চিন্তা করছে ওই লোক দু’টো এখনও ওদের জিনিসপত্রের কাছে বসে আছে কিনা তাই নিয়ে । এমন সময় সৌরীশ হঠাৎ পিছন ফিরে দৌড়ে গেল নদীর দিকে । ডান হাত দিয়ে জলের সামনে থেকে কী যেন একটা খামচে তুলে নিয়ে , দৌড়েই ফিরে এল আবার । সৌরীশ অল্প হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের সামনে এসে মুঠো খুলল । বন্ধুরা দেখল সৌরীশের হাতে এক তাল ভেজা মাটি । কেউ কোনও প্রশ্ন করার আগেই ও হাতের মুঠো মুখের খুব কাছে এনে, চোখ বন্ধ করে জোরে একবার শ্বাস নিল । তারপর বলে উঠল --- “এই গন্ধটাই তো হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম এতদিন ধরে ।“  সৌরীশের কথায় এক অদ্ভুত তৃপ্তির সুর ফুটে উঠল, যা ওর বন্ধুরা আগে কোনওদিন শোনেনি । অথচ সবাই নিমেষে অনুভব করল , সৌরীশের কথাটা কোথায় যেন লুকিয়ে ছিল সবার বুকের ভিতরে ।

                                          ----------------






রোমান্টিক গল্প


প্রেমের গল্প

ভালো গল্প


রোমান্টিক গল্প

প্রেমের গল্প

গল্প লেখা

ভালো গল্প

হাসির গল্প

জীবনের গল্প

সাইকেলের গল্প

পাখির গল্প



কেরালার বৃহত্তম জিপলাইন adventure sport

  ### কেরালার বৃহত্তম জিপলাইন ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য কেরালা, যার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যময় পরিবেশ পর্যটকদের আকর্ষণ করে, সেখানে এ...