পাড়ার প্রায় সকলে বিনুদিকে অপছন্দ করে । এর পিছনে দু'টো কারণ আছে --- এক, বিনুদির কটু কথা বলার অভ্যেস , আর দুই, ছেলেমেয়েদের মেধা নিয়ে তাঁর মাত্রাতিরিক্ত গর্ব করে বেড়ানো । একটা মানুষের বিরক্তির কারণ , আরেকটা আড়ালে হাসি-ঠাট্টার । বিনুদির দুই মেয়ে , এক ছেলে । তারা সকলেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার ছাত্রছাত্রী আর সত্যিই মেধাবী । এবং সেই কারণেই মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যারপরনাই উন্নাসিক । পাড়ার সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে তাদের মধ্যে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব চলে আসে । এইসব কারণে ওঁদের সংসারটা পাড়ার মধ্যে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত । সময়ের দাবি মেনে একে একে বিনুদির , মানে আমাদের বিনু জ্যেঠিমার, সব ছেলেমেয়েদের মস্ত বড় বড় সব ঘরে বিয়ে হল । আমরা কবজি ডুবিয়ে দু'তিন বছর পরপর নেমন্তন্ন খেলাম । অভাবে স্বভাব নষ্ট । অভাব না থাকলে, এ সমাজে চলার পথে হোঁচট না খেলে আর স্বভাব নিয়ে কে ভাবে ? ওঁরাও স্বভাব নিয়ে ভাবেননি । হয়ত ভেবেছিলেন , জীবনটা একই খাতে বইবে সারাজীবন । কিন্তু তা তো হয়না , ওঁদের ক্ষেত্রেও হলনা । সৃষ্টি কর্তার হাতে যে খাতা থাকে , তাতে প্রত্যেকের জীবনের পৃষ্ঠায় দু'টো স্তম্ভ থাকে , একটা প্রাপ্তির , আরেকটা অপ্রাপ্তির । কর্তামশাই স্বয়ং সেই তালিকায় নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রাখেন , নির্দেশও করেন-- দাঁড়িপাল্লার কাঁটার মত । আমরা যত বড় হতে লাগলাম , সেই সূচকটা তত স্পষ্ট ভাবে সকলের চোখে পড়তে লাগল । ওঁদের সমাজবিচ্ছিন্নতা ব্যুমেরাং হয়ে ওঁদের দিকেই ফিরে এল , যেমন আসে । মেয়েরা বিয়ের পর চোখে পড়ার মত যোগাযোগ কমিয়ে দিতে দিতে বন্ধ করে দিল । অঙ্কের স্কুল শিক্ষক ছেলে আরও উন্নতি করে অধ্যাপক হয়ে বদলি নিয়ে অন্য জেলায় চলে গেল । কিন্তু চলে যাওয়ার আগে ওঁদের বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা হতে হতে যে হলনা , সেটা জানল মাত্র পাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা । বিনু জ্যেঠির বৌমা উচ্চশিক্ষিতা । ফলে ওঁর দাপুটে ব্যক্তিত্বের কারণে দু'জনের কলহ বাধল এবং বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেটা একেবারে বাড়িতে কাক বসতে পারেনা , এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল । তিক্ততা চরম পর্যায়ে পৌঁছলে, একদিন ওঁর ছেলের বৌ কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন । শেষ মুহূর্তে তাঁর হাত ধরে টেনে যিনি পরিবারটির সম্মান রক্ষা করলেন , পাশের বাড়ির সেই প্রতিবেশীর সাথেও তাঁদের দিন শুরু হত তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে অকারণ নিয়মিত তর্কাতর্কিতে । পাকাপাকি ভাবে ছেলেমেয়েদের সাথেও ওঁদের আর কোনও যোগাযোগ রইল না । জ্যেঠুর অবসর গ্রহণের পরে ওঁরা দু'জন পরিবার ও সমাজ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রইলেন পাড়ায় । ওঁরা স্বভাবে কিছুটা ভাঙলেন এরপর , কিন্তু মচকালেন না । যে ছেলেমেয়ে কোনও খোঁজখবর রাখে না , তাঁদের নিয়ে ওঁদের ফলাও করে গল্প করার স্বভাব, ওঁদের আড়ালে হাসির খোরাক করে তুলল । আর কিছু মানুষ সহজাত সহানুভূতিশীলতার কারণে শত অপমান এবং বিরক্তি সত্ত্বেও বিপদেআপদে ওঁদের পাশে এসে দাঁড়াতে ভুললেন না । বরং নিজেদের সামাজিক কর্তব্য বলে মনে করলেন , যেমনটা আর পাঁচ জনে করেন ।
তারপর , আমরা বুড়ো হয়েছি । ওঁরা নবতিপর- অশীতিপর হয়ে মাস দুয়েকের ব্যবধানে দেহ রেখেছেন বছরখানেক আগে । কারও মুখাগ্নিই ছেলে করেননি , এক নিকটাত্মীয় করেছেন । অতঃপর এই জগৎ-সংসারে এই দু'টি অদরকারি মানুষ যে বাড়িটিতে থাকতেন , অনিবার্যভাবে সেটির বিক্রির প্রশ্ন এসেছে, এবং কিমাশ্চর্যম অতঃপরম, তখন ঠিক তিন ছেলেমেয়ের মাথা এক হয়েছে ! সব দেখেশুনে পাড়ার প্রবীণেরা কেউ কেউ সবেগে দু'দিকে মাথা নাড়িয়ে, মুখে চুকচুক শব্দ করে বললেন --- এমনটাই তো হওয়ার ছিল । আর কেউ কেউ এই ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীরবে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.