সাবেক কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা দেখা আমার বহুদিনের ইচ্ছে ! এমন অদ্ভুত ইচ্ছের কারণ কী ? কাগজে পড়েছি সেই ব্রিটিশ আমলে তৈরি কলকাতার ভূগর্ভস্থ নিকাশি ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি । ফলে সেই আমলে তৈরি ভূগর্ভস্থ দেওয়ালগুলিই এখনও বিরাট নালার কাজ করে মহানগরে । সেই দেওয়ালগুলোর চেহারা দেখা আমার বহুদিনের সাধ । এমনিতে উপায় নেই , এই সুযোগ একমাত্র মিলতে পারে ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা হলে । একদিন আচমকাই চাঁদনি চকের কাছে সেই সুযোগ হল । ম্যানহোলে নেমে কাজ করছিলেন পুরকর্মীরা । আমি উঁকি মেরে যতটা সম্ভব খুঁটিয়ে দেখছিলাম । উপরে যে সব পুরকর্মী দাঁড়িয়েছিলেন , তাঁদের একজন হঠাৎ আমাকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে অস্ফুটে বললেন ---- "সরি ।" খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বললেন ---- "বিষাক্ত গ্যাসে মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন ।" কিন্তু 'সরি' কেন ? উনি আমাকে ছুঁয়ে ফেলেছেন তাই । ওঁর সৌজন্যবোধ আর উপস্থিত বুদ্ধি সেদিন লজ্জা দিয়েছিল আমায় ।
ষোল বছর পার করেও কলকাতা আমার কাছে এখনও অচেনা । খুব চেনা রুট না হলে সাধারণত কন্ডাক্টরকে গন্তব্য জানিয়ে ডেকে দিতে বলি । সেদিন নামব ই. এম. বাইপাসে , ধাপার মাঠের কাছে । গন্তব্য আসার পর কন্ডাক্টর ডেকে তো দিলেনই , নেমে যাওয়ার পরে বললেন ---- "সাবধানে রাস্তা পার হবেন ।" শুধু এই একটি বাক্য খরচ করে উনি আমার মনের মণিকোঠায় স্থায়ী জায়গা দখল করে নিয়েছেন ।
কলকাতার বন্ধুরা হাত ধরে চিনিয়েছিল ধর্মতলায় ডেকার্স লেনের 'চিত্তবাবুর দোকান' --- অফিস পাড়ার বাবুদের টিফিন করার খুব প্রিয় জায়গা । এখানে বিশেষ করে চোখে পড়ে কলকাতা হাইকোর্টের উকিলদের । খানদানি চায়ের কাপ - পেয়ালা , খাবার প্লেট তো আছেই , এই দোকানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গেলে , বলতেই হয় ওঁদের বিরাট উঁচু কাঠের টুলটার কথা , যেটার উপর দোকানের মালিক বসে থাকেন । কাগজে ওঁদের বিরাট সুনামের কথা পড়েছি । সেটা কেন , বুঝলাম একদিন বৈকালীন জলযোগ সারতে গিয়ে । সেদিন দোকানের সামনে বসার জায়গায় তিল ধারণের জায়গা নেই । আমি, সত্যি কথা বলতে কী , কাঁধের ব্যাগ আর হাতের প্লেট সামলে , কিছুতেই মানিব্যাগটা ম্যানেজ করতে পারছিলাম না । হঠাৎ টুলের উপর থেকে দোকানের মালিক বাড়ির বড়দের মত শাসনের সুরে বললেন ---- "আঃ । অত তাড়ার কী আছে ! খেয়ে নিন আগে । পরে টাকা দেবেন ।" চিকেন স্টুটা কেন যেন অমৃত মনে হচ্ছিল সেদিন । জলপাইগুড়ি থেকে এসে পড়েছি এমন এক জনসমদ্রের কাছে , যেখানে আমাকে কেউ চেনে না । একটা দুর্ঘটনা ঘটলেও বাড়িতে খবর পৌঁছতে অন্তত ছয়- সাত ঘণ্টা সময় লাগবে । প্রথম প্রথম তাই বড্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম । এরকম আন্তরিক ব্যবহার পেতে পেতে , এখন একটু বুকে বল পাই । কবীর সুমন বোধহয় আমাদের মত মানুষদের কথা ভেবেই লিখেছিলেন ----- "লোকটা দেখল ঠিক দু'তিনটে হাত যায় জুটে ।"
অসংখ্য গল্প আছে । কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি ! ২০১২ সাল । জুলাই মাস । বাবা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি । পরপর রাত জাগা চলছে । একদিন সকালে জরুরি কাজে ভাইকে হাসপাতালে রেখে লোকাল ট্রেনে ফিরে আসছি ব্যারাকপুরে । ট্রেনে ওঠার পর থেকে মাথাটা ঘুরছিলই , সোদপুরের কাছাকাছি এসে হঠাৎ ভীষণ বমি পেল । টলতে টলতে দরজার কাছে গিয়ে হাতলটা কোনওমতে ধরে বাইরে ঝুঁকে পড়লাম । অপ্রত্যাশিত ভাবে এক জোড়া হাত নেমে এল আমার কাঁধে । পিছনে তাকিয়ে দেখি , আমারই বয়সী এক ভদ্রলোক বলছেন --- বসে পড়ুন , নইলে পড়ে যাবেন । নিজেকে সামলে সিটে এসে গা এলিয়ে দিলাম । উনি হাত ধরে ব্যারাকপুরে আমাকে নামিয়ে দিলেন । বাড়িতে এসে ওষুধ খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করার পর খেয়াল হল, ওঁকে একটা ধন্যবাদও জানানো হয়নি , উনি হারিয়ে গেছেন শহরতলির জনারণ্যে ।
https://sankhamanigoswami.blogspot.com/2020/08/%20pub-9792609886530610_16.html
কলকাতা , তুমিও হেঁটে দেখ ক-ল-কা-তা...
ফিচার প্রতিবেদন
ফিচার সংবাদ
ফিচার নিউজ
ফিচার পাতা
ফিচার লেখা
news feature article
news feature story
news feature example