পুজো আসলেই মনটা কেমন কেমন করে ওঠে অজয়ের । সারা বছরের মূল রোজগারটা যে এই সময়েই হত । দেবীপক্ষ শুরু হয়ে গেলে নাওয়াখাওয়ার সময় থাকত না । বিচিত্রানুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা অনেক আগে থেকে বরাত দিয়ে যেতেন । বিশেষ কদর ছিল অজয়ের বাইশ মিনিটের একটি অনুষ্ঠানের । একদল দামাল ছেলের ট্রেনে চড়ে বরযাত্রী হিসেবে গ্রামের এক বিয়ে বাড়িতে যাওয়া নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে একা গল্প বলত অজয় । ছবির মত একেকটা দৃশ্য ফুটে উঠত দর্শকদের চোখের সামনে । কীভাবে ? মুখ দিয়ে বের হওয়া নানারকম ধ্বনিতে । এককালে পেশাদার হরবোলা ছিল অজয় । ট্রেনের শব্দ , বরযাত্রীদের গলার আওয়াজ , বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততা , পঙক্তিভোজনের হাঁকডাক, সব একা গলার স্বরে ফুটিয়ে তোলার মধ্যে একটা আলাদা চ্যালেঞ্জ ছিল । এ কাজে টাকার চেয়েও বড় পুরস্কার ছিল দর্শকদের মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিয়ে ওঠা । একটা দলও ছিল অজয়দের । ওরা তিনজন একসঙ্গে অনুষ্ঠান করতে যেত । এক বন্ধু হাতের কারসাজিতে জাদু দেখাত , আর একজন কথা বলাতো পুতুলকে । পুতুল নয় , আসলে গলা পাল্টে বন্ধুই ঠোঁট-মুখ না নাড়িয়ে মজার মজার কথা বলত , লোকে ধরতে পারত না । ইংরেজিতে নাকি , এই কাজটার একটা গালভরা নাম আছে --- ভেন্ট্রিলোকুইজম । একবার সত্যজিৎ রায়ের একটা গল্প পড়ে শিখেছিল অজয় । ভাল লেগেছিল গল্পটা । এটা তো তাদেরই জীবনের গল্প ।
লোককে আমোদিত করে বেশ কাটছিল দিনগুলো । হঠাৎ টিভিতে একগাদা চ্যানেল এসে আস্তে আস্তে দর্শকদের চাহিদা পাল্টে দিল । হরবোলা-জাদুকর-কথা বলা পুতুল নয় , লোকে এখন সারা বছরই সপ্তাহভর সন্ধে থেকে বাড়িতে বসে টিভি সিরিয়াল দেখে , আই পি এল , আই সি এল দেখে । পুজোর ক'টা দিনও এই রুটিনের অন্যথা হয়না । বিনোদনের সংজ্ঞাটা কী পাল্টে গেছে ? অজয়দের দিন শেষ ? না বোধহয় । অজয় টিভিতেই দেখেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিরল প্রতিভাদের জনসমক্ষে তুলে আনার অনুষ্ঠান করছে কিছু চ্যানেল , সেইসব অনুষ্ঠানের গালভরা নামও আছে একটা --- ট্যালেন্ট হান্ট শো । সেইসব অনুষ্ঠানে যেতে গেলে অডিশন দিতে হয় । এরপরেরবার যখন ব্যারাকপুরে অডিশন নেবে ওই চ্যানেল , তখন সেখানে নাম দেবে অজয় হরবোলা । দুনিয়াকে বুড়ো হাড়ে ভেল্কি দেখিয়ে দেবে , ঠিক করেই রেখেছে অজয় ।
অজয় তাই আজকাল নিয়ম করে প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার সেই বাইশ মিনিটের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মহড়া দেয় , আর পেট চালাতে একটা বৈদ্যুতিন যন্ত্র সারাইয়ের দোকান চালায় । বুভুক্ষুর মত যে কোনও কাজ পেলেই হাতে নেয় না সে । যে ইন্ডাকশন , মিক্সি , টিভি সারাই করতে গিয়ে আর পাঁচজন হাল ছেড়ে দিয়েছে , বেছে বেছে সেই কঠিন কাজগুলো হাতে নেয় অজয় । যে কাজে মাথা খাটিয়ে সফল হতে হয় , সেই কাজগুলোই অজয়কে মানসিক তৃপ্তি দেয় । সে অজয় হরবোলা । বাঘ থেকে বিড়ালের ডাক নিখুঁতভাবে অনুকরণ করে লোককে একসময়ে সে মুগ্ধ করেছে । অজয় মিস্ত্রির কাজেও যেন সবার তাক লেগে যায় । তারিফ করে সবাই সেই আগের মতই যেন বলে --- "নাহ , এলেম আছে আপনার !"
https://sankhamanigoswami.blogspot.com/2020/09/%20pub-9792609886530610_25.html

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.