ত্রাসের নাম আমপান
এইচ বি ও –তে স্টিফেন স্পিলবার্গের ঘূর্ণিঝড় নিয়ে ছবি ‘টুইস্টার’
বহুবার দেখা । উপভোগ্য ছবি । দুর্দান্ত স্পেশাল এফেক্টের কাজ । কিন্তু স্বচক্ষে ২০-০৫-২০
তারিখে নিজেদের বাড়ির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘আমপান’-এর যে ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ
করলাম, তারপর ঠিক করেছি আর কোনও দিন ‘টুইস্টার’ দেখব না ! প্রকৃতি রুষ্ট হলে , তার
চেহারা যে কী অকল্পনীয় বিভীষিকাময় হতে পারে , তার কিছুটা আঁচ পেয়ে মনে হয়েছে , ‘টুইস্টার’-এ
গরু – গাড়ি উড়ে যাওয়ার দৃশ্য এর কাছে নস্যি । এই বুধবার বিকেল তিনটে থেকেই বৃষ্টির
সাথে হাওয়ার দাপট বাড়ছিল । সেটা চরমে পৌঁছল সন্ধে সাতটা নাগাদ । কাগজে আগে পড়েছিলাম
‘আমপান’(নামকরণ করেছিল তাইল্যান্ড । অর্থ-- আকাশ)-এর সম্ভাব্য গতিবেগ ১১০-১৩০ কিমি/ঘণ্টা
এবং দক্ষিণবঙ্গে শেষ বিধ্বংসী ঝড় ‘আয়লা’র গতিবেগ ছিল ৭০ কিমি/ঘণ্টা । ঝড় থামার পরে
জানা গেল, পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অঞ্চল ও দক্ষিণ এবং উত্তর চব্বিশ পরগনার কিছু জায়গার
উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় ‘আমপান’ –এর গতিবেগ ১৪৫ কিমি/ঘণ্টা হয়েছিল , যার নজির গত আড়াই
শতকে নেই । এই ঝড়ের গতিবেগ যে ‘আয়লা’র দ্বিগুণ তা সন্ধে ঘনাতেই মালুম হচ্ছিল । এক নাগাড়ে
চলছিল প্রচণ্ড বৃষ্টি আর তীব্র হাওয়া । হাওয়ার এত কান ফাটানো – বুক কাঁপানো শব্দ আমি
আগে কখনও শুনিনি । বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম , হাওয়ার প্রচণ্ড বেগে তাতেই শরীর
নড়ে যাচ্ছিল । ঘরে এসে দরজা বন্ধ করলাম । হরর ফিল্মে যেভাবে অদৃশ্য শক্তির ধাক্কায়
দরজা কাঁপতে দেখা যায় , একদম সেইভাবে মুহুর্মুহু দরজা –জানলা থরথর করে কাঁপতে লাগল
ঘূর্ণি হাওয়ার আঘাতে । লোডশেডিং হয়েছিল বিকেল চারটেতেই । রাত আটটা নাগাদ মনে হচ্ছিল
, প্রকৃতি নামক এক বিরাট কালো দৈত্য যেন ভীষণ রাগে ফুঁসছে । ন’টা নাগাদ লাগাতার হাওয়ার
ঝাপটা একটু স্তিমিত হল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর আগের চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি বেগে হঠাৎ হঠাৎ
দমকা হাওয়া বওয়া শুরু হল । আর তার সাথেই চলতে লাগল আমাদের বাড়ির আশপাশ থেকে ঝড়-বৃষ্টির
শব্দকেও ম্লান করে দিয়ে বিভিন্ন বাড়ির টিনের চাল আছড়ে পড়ার পিলে চমকানো শব্দ । সাড়ে
এগারোটা নাগাদ যখন ঘুমে চোখ বুজে এল , তখনও অবিরাম এই প্রলয় নাচন চলছে । বিকট শব্দে
বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে । নটরাজের মূর্তি অনেকবার দেখেছি , এই রাতে তাণ্ডব কাকে বলে
তা কিছুটা দেখলাম , বেশিরভাগটাই শুনলাম ।
পরদিন সকালে উঠে দেখলাম বৃষ্টি থেমেছে ।
কিন্তু বাড়ির গেটের সামনে একহাঁটু জল , যা আগে কোনওদিন হয়নি । বেলা একটু গড়াতে সকলে
বালতি নিয়ে পাড়ার নলকূপ থেকে জল আনতে ছুটলেন সেই জল ডিঙিয়ে , কারণ গতকাল বিকেল থেকে
পুরসভার জল আসছে না । কারণ পাম্প চালাবার উপায় নেই । দেখলাম , বাড়ির সামনের রাস্তার
জলে দিব্যি খেলা করছে তেলাপিয়া – পুঁটি মাছ ! আমাদের বাড়ির কাছেই একটা বিরাট দীঘি আছে
। অনেকে বললেন, উপচে পড়া সেই দীঘি থেকেই মাছ আসছে । সাধারণত ভারী বৃষ্টি হলে , ঘণ্টা
দু’য়েকের মধ্যেই আমাদের পাড়ার জল নেমে যায় রাস্তা থেকে । কিন্তু এ যাত্রায় গেল না ।
কারণটা ব্যাখ্যা করলেন পাড়ার প্রবীণেরা । গঙ্গার জল শহরে ঢুকে পড়েছে , তাই জল বেরনোর
সব পথ বন্ধ । একটা গোটা দিনেরও বেশি সময় লাগল এবার জল নামতে । ছাদে উঠে দেখলাম , বেশকিছু
বটপাতা পড়ে রয়েছে । অথচ আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় বটগাছ নেই ! আমাদের আশপাশের প্রায়
প্রতিটি বাড়িতে, গ্রীষ্মের প্রকোপ থেকে বাঁচতে , লোহার কাঠামোর ওপরে করোগেটেড টিনের
ছাউনি দেওয়া, বাড়ির ছাদে । দেখলাম , চারপাশের বেশ কয়েকটা বাড়ির ছাদে , লোহার খাঁচা
থেকে উপড়ে টিনের বিরাট বড় বড় আচ্ছাদনগুলো বিলকুল উধাও ! কাছেপিঠে কোনও জায়গায় তার টিকিটিও
দেখা যাচ্ছে না । নির্মীয়মাণ বিভিন্ন বাড়ির ছাদে – সিঁড়িতে ইতস্তত পড়ে রয়েছে দূরের
কোনও বাড়ির টিনের চাল । দুমড়ে – মুচড়ে যাওয়া মাথার ছাদের খোঁজে হাঁকডাক চলছে ।
২০ – ০৫ -২০ , বুধবার রাত সাড়ে ন’টা – পোনে
দশটা পর্যন্ত ফোন করেছি । তারপর থেকে যেন গন গনা গন সেই যে গন , নেভার রিটার্ন – এর
গল্প । আমরা তখন নেই-রাজ্যে । বিদ্যুৎ নেই , নিত্য ব্যবহার্য জল নেই , মোবাইল সংযোগ
নেই , ইন্টারনেট নেই এবং সর্বোপরি ২১-০৫-২০ তারিখের বিপর্যস্ত শহরে খবরের কাগজও নেই
। যিনি কাগজ দেন , তাঁর আসার পথই তো উপড়ে পড়া বড় বড় গাছ , বিদ্যুতের ছেঁড়া তার , ধরাশায়ী
বিদ্যুতের খুঁটি ও জল জমে বন্ধ । এককথায় , তখন সভ্য জগতের সাথে আমাদের সমস্ত যোগাযোগ
বিচ্ছিন্ন । ২২-০৫-২০ তে এই লেখা যখন লিখছি , তখন হাতের কাছে শুধু খবরের কাগজ । বাইরের
জগতের সাথে ওইটুকু যোগাযোগই স্থাপন করা গেছে । রাস্তার জল এখন পুরোপুরি নেমে গেছে ।
কয়েকজন ঘুরে এসে জানালেন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ করছেন পুরসভা ও বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীরা
। বেলা এগারোটা বাজে এখন । বৃষ্টি থামায় রোদের তাপ বাড়ছে । আজকে কারেন্ট চলে এলে বড্ড
ভাল হয় । আরেকটা হলিউডি ছবির কথাও মনে পড়ছে এখন --- ‘স্ট্র্যান্ডেড’ ।
শুক্রবার রাত সাড়ে আটটায় কলে জল এল । রাত পর্যন্ত
মোবাইলের টাওয়ার আসছে – যাচ্ছে । কোনও কাজ করা যাচ্ছে না । শনিবার রাত দু’টো নাগাদ
বিদ্যুৎ এল । মনে হচ্ছে এবার ধীরে ধীরে জীবনের ছন্দে ফিরব আমরা । কিন্তু শহরেরই যদি
এইরকম বিষম অবস্থা হয় , তবে এই মহাপ্রলয়ের পরে, ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলের দৈনন্দিন
জীবন কবে স্বাভাবিক হবে , আদৌ হবে কি না, তা নটরাজই জানেন ।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.