কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠ ভরা বিষ
কেবলই আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ ।।
---- রায়গুনাকর ভারতচন্দ্র ।
উত্তর চব্বিশ পরগনার চানক তথা ব্যারাকপুরে কলকাতার জানবাজারের রানি রাসমণিদেবীর কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বাদেবী ও তাঁর স্বামী মথুরামোহন বিশ্বাস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও নির্মিত শিবশক্তি - অন্নপূর্ণা মন্দিরে , অন্নপূর্ণা ও নীল পুজো হল ১৩/০৪/২০১৯ তারিখে । রানি রাসমণির স্বপ্নের ফসল এই
দ্বিতীয় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরটির ইতিহাস ঘাঁটলে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে ।
‘চানক’ জায়গাটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের ‘মনসাবিজয় কাব্য’ –
তে(১৪১৭ শকাব্দ / ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দ) । এখনও এখানকার জমির খাজনার রসিদে চানক মৌজা
উল্লিখিত হয় । এই মন্দিরের বিগ্রহটি অষ্টধাতুর । দেবী অন্নপূর্ণার বাঁ হাতে
অন্নপাত্র , ডান হাতে, হাতা । পাশে দাঁড়িয়ে শিব খেতে চাইছেন । দেবীর পায়ের নীচে
গরুড়ের মূর্তি । গর্ভগৃহের মেঝে মার্বেলের । মন্দিরের প্রবেশ ফটকের উপরে আছে একটি
সিংহ মূর্তি । মন্দিরে ঢুকেই বাঁদিকে নাটমন্দির , ডান দিকে দফতরখানা । মন্দিরের
পিছনের গেটের দু’পাশে, সম্ভবত ছিল দারোয়ানের ঘর । এই মন্দির চত্বরে ছ’টি শিব
মন্দিরও আছে । দক্ষিণেশ্বর ও অন্নপূর্ণা মন্দিরের নির্মাণশৈলী হুবহু এক । তবে,
তুলনায় অন্নপূর্ণা মন্দিরটি সামান্য উঁচু । রামকৃষ্ণ পরমহংস মোট চারবার এই মন্দিরে
এসেছেন । প্রথমবার , মন্দিরের জমি কেনার সময় , তারপর ভিতপুজো উপলক্ষে । তৃতীয়বার ১৮৭৫ সালের ১২ এপ্রিল মন্দিরের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার দিন , আর শেষবার মূল
বিগ্রহটি দেখতে । রানির জামাই মথুরামোহনবাবুই সব কাজের তদারকি করতেন । যদিও এই
মন্দিরের দ্বারোদঘাটন তিনি দেখে যেতে পারেননি । ১৮৭১ সালের ১৬ জুলাই তিনি মারা যান
। এই মন্দিরটি তৈরি করতে সেই সময়েই খরচ হয়েছিল প্রায় তিন লাখ টাকা । শেষবার এসে
রামকৃষ্ণ মন্দির প্রাঙ্গণে বেলতলায় কিছুক্ষণ বসেছিলেন উল্টোরথের দিন । ‘রামকৃষ্ণ
কথামৃত’তে এই মন্দিরের উল্লেখ আছে । শেষবার এখানে এসে রামকৃষ্ণ, রানি রাসমণি ঘাটে
স্নান করেছিলেন । মন্দির তোরণে সিংহমূর্তি স্থাপন নিয়ে মন্দির কর্তৃপক্ষের সাথে
ব্রিটিশদের বিরোধ বাধে । তারা একেবারেই চায়নি ব্রিটিশদের শৌর্যের প্রতীক সিংহ
মন্দির – তোরণে ঠাঁই পাক । এই নিয়ে মামলা হয় এবং ব্রিটিশরা হেরে যায় । এই মন্দিরে
আমিষ ভোগ হয় । রানির উত্তরপুরুষেরাই বিগ্রহের সেবা করেন । রোজ ভোর পাঁচটায়
মঙ্গলারতি , দশটায় পুজো , বারোটায় ভোগ ও আরতি , বিকেল চারটেয় বৈকালিক ও গীতাপাঠ ,
এবং সন্ধ্যায় আরতি হয় - শীতে সাড়ে ছ’টা ও গ্রীষ্মে সাতটায় । এরপর ভোগ সাড়ে সাতটায়
। মন্দিরটি বি টি রোডের কাছে , গান্ধীঘাটের রাস্তায় । (তথ্যসূত্র : ‘ব্যারাকপুরের
সেকাল – একাল’ , প্রথম খণ্ড , সম্পাদনা : কানাইপদ রায় ।)
স্থানিয়েরা তো বটেই , পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি থেকেও এই দিনটিতে প্রতিবছর বহু মানুষ আসেন পুজো দিয়ে ভোগ নিতে । এ বছরও তার অন্যথা হয়নি । অন্যান্যদিন মন্দিরের পিছনের গেটটি পুরোপুরি বন্ধ থাকে , এবং সামনের গেটটিও মানুষ চলাচলের মত ফাঁক রেখে শেকল দিয়ে বাঁধা থাকে । একমাত্র পুজোর দিনটিতেই বিরাট জনসমাগমের কারণে ফটক দু 'টি খুলে দেওয়া হয় দেবোত্তর এস্টেটের পক্ষ থেকে । মন্দিরে ঢুকতেই ডানদিকে টিটাগড় পুলিশের তাঁবু । বাঁ দিকে ভোগ রান্না ও বিতরণের এলাহি আয়োজন । দেবোত্তর এস্টেটের ব্যাজ পরা স্বেচ্ছাসেবকেরা মূল মন্দিরের গর্ভগৃহের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছিলেন , যাতে সকলে সুষ্ঠুভাবে পুজো দিতে পারেন । গর্ভগৃহে ঢোকার লম্বা লাইনে না দাঁড়িয়ে অনেকেই গঙ্গাজল-ফুল- বেলপাতা - প্রণামি বন্ধ দরজার সামনেই দিয়ে যাওয়াতে শান বাঁধানো চাতালটা জলে থইথই করছে । একটু অসতর্ক হলেই পা হড়কে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা । অন্নপূর্ণা ঘাটে গঙ্গায় স্নান করে এসে পেছনের ফটক দিয়ে ঢুকে পরপর ছ'টি শিবমন্দিরে পুজো দিচ্ছেন অনেকে সিক্ত বসনে । নাট মন্দিরে অনেকগুলি পেডেসটাল পাখা রাখা যাতে প্রচণ্ড গরমে পুণ্য করতে আসা মানুষেরা একটু স্বস্তি পান । এর মধ্যেই হঠাৎ সরে যান , সরে যান রব । সস্ত্রীক পুজো দিতে এসেছেন পুলিশ কমিশনার । নাট মন্দিরের সামনে বস্তা ভর্তি নকুলদানা বিলি করছিলেন এক বৃদ্ধ । এক সিভিক ভলান্টিয়ার দু' হাত ভরে নকুলদানা নিয়ে ঢেলে দিলেন কমিশনারের স্ত্রী - এর রেকাবিতে । ওনাদের সঙ্গে যে সব পুলিশ আধিকারিকেরা এসেছিলেন , তাঁরা নিচেই দাঁড়িয়ে রইলেন । ওঁরা যেমনভাবে এসেছিলেন তেমনই পুজো দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ।
স্নান করে ভেজা কাপড় মন্দিরপ্রাঙ্গণেই ঘাসে শুকোতে দিয়েছেন মহিলারা । পিছনের ফটক দিয়ে নাক বরাবর অন্নপূর্ণা ঘাটের দিকে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তায় থিকথিকে ভিড় । প্রতি বছরের মতই সে রাস্তার ওপর বিক্রি হচ্ছে পুজোর নানা উপকরণ । আর ঘাটের সামনেটায় আর পাঁচটা তীর্থস্থানের মতই সারিবদ্ধভাবে হাত পেতে বসে ভিখিরিরা । মায়েরা ছেলেমেয়েদের হাত দিয়ে দান সামগ্রী ঢেলে দিচ্ছেন ভিক্ষাপাত্রে । গত দেড়শ বছরের মধ্যে বোধহয় এই দৃশ্যের কোনও পরিবর্তন হয়নি । দেশের অন্যান্য তীর্থস্থানের মতই গঙ্গার ঘাটে পুজো দেওয়া ও স্নান করার পরিচিত ভিড় । এ পর্যন্ত যা কিছু চোখে পড়েছে তার মধ্যে বিসদৃশ কিছু নেই । বিশৃঙ্খলা শুধু একটি ক্ষেত্রেই ---------- গঙ্গায় স্নান করে উঠে নানা বয়সী মেয়ে ও মহিলারা প্রকাশ্যেই ঘাটের একপাশে ও নাটমন্দিরে পোশাক পরিবর্তন করছেন । সামান্য আড়ালটুকুও নেই । যিনি নকুলদানা বিলি করছিলেন তাঁকে ব্যাপারটা বললাম । উত্তর এল , "মায়ের মন্দিরে লজ্জা কীসের ? সবাই তো এভাবেই ... যদি একান্তই অসুবিধে হয় তবে শিবমন্দিরের পিছন দিকটায় চলে যেতে বলুন । " বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ , তর্ক করতে ইচ্ছে করলনা , শুধু মনে মনে বললাম , মায়ের মন্দিরে লজ্জা করতে নেই তো বুঝলাম , কিন্তু এতশত ক্যামেরাকে বাধা দিতেও কি নেই ? তাছাড়া এত লোকের মাঝে মন্দিরে তো চুরির ভয়ও থাকা উচিৎ না । তাহলে প্রণামির বাক্সটা সিঁড়ির হাতলের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা কেন ? লজ্জা পেতে মানা অথচ চুরির ভয় পেতে মানা নেই ------ এটাই বা কেমনতর কথা ? এই ঘাটে নেমে ডানদিকে তাকালে গান্ধিঘাট । সেখানে যে মহিলাদের আলাদা কাপড় পাল্টানোর ব্যবস্থা আছে তাই-ই নয় , ভি আই পি শৌচাগারও আছে দস্তুরমত । পাশাপাশি দু' টি ঘাটের ব্যবস্থাপনায় এমন বৈষম্য কেন ? আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল এত মানুষ স্নান করছেন , অথচ কোন বিপদ মোকাবিলা বাহিনি নেই কেন , রিভার ট্র্যাফিক পুলিশই বা নেই কেন ? কেন নেই লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা বা টিউব ? ঘাটে প্রশাসনিক ঘোষণার কোন ব্যবস্থাও নেই কোথাও । জোয়ার এলে কী হবে ?
কিছুদিন আগেই এক সমীক্ষায় দেখা গেছে গঙ্গাজলে অত্যন্ত বিপজ্জনক মাত্রায় কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া রয়েছে শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় । অথচ এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে সরকারি বা বেসরকারি কোনরকম উদ্যোগই চোখে পড়ল না । অন্নপূর্ণা মন্দির ও দক্ষিণেশ্বর মন্দির রানি রাসমণির মাধ্যমে একই সূত্রে বাঁধা । অন্নপূর্ণা মন্দিরটি দক্ষিণেশ্বর থেকে সামান্য উঁচু । রামকৃষ্ণ পরমহংসের নামটি দু' টি মন্দিরের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ------ তবুও দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের জন্য বরাদ্দ তৎপরতা , আর অন্নপূর্ণা মন্দিরের জন্য শুধুই উদাসীনতা । কেন ?
সন্ধেবেলায় আলোর সাজে মন্দিরের অন্যরূপ । ভিড়টা হালকা , ঘাট সুনসান । বেশ কিছু বিত্তবান মানুষ পুজো দিয়ে প্রচুর মিষ্টি বিলি করলেন সবার মধ্যে । যাকে বলে মধুরেন সমাপয়েৎ !
annapurna temple barrackpore,
annapurna temple varanasi,annapurna temple karnataka,annapurna temple tirwa kannauj,annapurna temple horanadu,annapurna temple indore,annapurna temple kashi,annapurna temple in india,annapurna temple kannauj,annapurna temple ambasan,annapurna temple trimbakeshwar,annapurna temple surat,annapurna temple in south india,annapurna temple mehsana

























কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.