আমার বাবা বড়ো হয়েছে পুরুলিয়া জেলায় কোনো এক গ্রামে।বাবা প্রথম যুবক বয়সে কলকাতার নামি সরকারি হাসপাতালে চাকরী(swiper) পেলেন। কিন্তু বিয়ে করে ছিলেন পুরুলিয়া য়।আমরা তিন ভাই বড়ো হলাম কলকাতায় , আমাদের পড়াশোনা হল কলকাতায়।
যখন আমি মাধ্যমিক পাশ করলাম তখন বাবা
ইচ্ছাকৃতভাবে চাকরির ট্রান্সফার করালো
পুরুলিয়ায়।কারন, পুরুলিয়ার সুন্দর প্রকৃতি, মনোরম আবহাওয়া , খোলা আকাশের নিচে শান্তি ভাবে জীবন যাপন কাটা।আমার পড়াশোনা আবার শুরু হল পুরুলিয়া তে। পুরুলিয়াতে আমার ঠাকুরদাদা যে গ্রামে থাকতো সেই জায়গায় পুনরায় বাড়ি বানিয়ে বসবাস করলাম আমরা।
বাবা যেই হাসপাতালে কাজ join করলেন আমাদের গ্রামের থেকে ১৮ কিমি দূরত্ব।বাসে ট্রাভেল করতে হয়। সেই হাসপাতালে দুটি কর্মচারী (swiper), আমার বাবা আর আরেকটি মাঝ বয়সী লোক অরূপ কাকা।
দু'জনের কাজ অদল-বদল করে হতো । যেদিন বাবা থাকত সেদিন অরূপ কাকা নিজের বাড়ি চলে যেতেন আর যেদিন অরূপ কাকা ডিউটিতে থাকতেন সেদিন বাবা বাড়িতে থাকতেন।বাবা যখন ডিউটিতে থাকতেন তখন দিন-রাত দুটি ই ডিউটি করতে হতো তাই বাবা অরূপ কাকার ইচ্ছায় ওনার কোয়াটার ব্যবহার করতেন।তাই বাবাকে আলাদাভাবে কোয়ার্টার নিতে হইনি।
কোয়াটার টি ছিল হাসপাতাল থেকে কিছুটা দূরে। কোয়ার্টার টির ধারে পাশে ছোট্ট ছোট্ট গাছপালা, ঝোপঝাড় ঘেরা।
দূর থেকে শুধু কোয়াটারের ছাদটা , জলের টাঙ্কি চোখে পড়ত। কোয়ার্টারটায় মোট চারটি রুম ছিল বাকি তিনটি রুমে তিনটি বিবাহিত নার্স ছিল ।
বাবা বেশ অনেক বার একা সেই কোয়ার্টার রাতে থাকার পর বাবা লক্ষ্য করলেন প্রায় মাঝরাতে জানলার দড়জায় কেও ঠক্ ঠক্ ঠোকার আওয়াজ করতেন।বাবা প্রথম প্রথম ব্যাপারটা কোনো পাত্তা দেইনি। কিন্তু অনেক বার একেইরকম ঘটনা ঘটার জন্য বাবা অরূপ কাকাকে জিজ্ঞেস করলেন আগেও কি এইরকম হতো?
অরূপ কাকা বলেছিল ,'সামনে একটী সাঁওতালি গ্রাম আছে ওইখানের সাঁওতালি চোর গুলো এইরকম করে।' দড়জায় জানলার ঠোকার আওয়াজ বন্ধ হওয়ার কয়েক মাস পর গভীর রাতে কোয়ার্টারের বাইরের জানলার ওপাশ দিয়ে কোনো নারীর কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। কান্নার আওয়াজ টা বেশির ভাগই আসত অরূপ কাকার রুমে ধারে পাশে থেকে।বাবা প্রথম ভেবেছিল কোনো প্রেসেন্ট মারা যাওয়ার কারণে তার আত্মীয় কান্নাকাটি করছে
কিন্তু বারবার একি কান্নার শব্দ ,তখন বাবা র মনে কিছুটা খটকা লাগল।
বাবা মাঝে মধ্যেই মদ্যপান করত ;তাই বাবা যখন বাড়িতে এসে এইসব ঘটনার কথাগুলো বলতেন তখন আমরা সবাই বাবাকে অবিশ্বাস্য করে কথা টা উড়িয়ে দিয়ে ছিলাম আর বাবাকে বোঝালাম হইত বেশি মদ্যপান করার জন্য ভুলভাল শুনতে পেয়েছিল।পরে যখন পাশের রুমে নার্সদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তখন তারাও সেই কান্নার শব্দের কথা স্বীকার করেছিল।
ভূত আছে কি নেই?
আত্মা আছে কি নেই?
এই সব কথা আলোচনা না করে বাবাকে ওইখানে একা ছাড়া যাবে না এটাই সিদ্ধান্ত হলো আমাদের পরিবারের। সেই বার থেকে বাবার সাথে মা নইত আমি যেতাম।
এমন একদিন সেই কোয়ার্টারে মা আর বাবা ছিল।সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল , প্রচুর গরম । পুরুলিয়ায় একটু বেশি গরম পড়ে।
সেদিন বেশি গরম লাগার জন্য মা আর বাবা ছাদে ঘুমাতে গেল ।
হাসপাতালে পেসেন্ট গুলোর যে ধরনের লোহার বেড্ দেওয়া হয় সেই রকম দুটি বেড কোয়ার্টারে ছাদে রাখা থাকত। সেই বেড দুটি তে মা একটাতে আর বাবা আরেকটি তে বিছানা পেতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঠিক রাত ১/১:৩০ সময় মায়ের বেডটা কোনো অচেনা শক্তি নিচ থেকে উপর দিকে উঠানোর চেষ্টা করছে,বেডের নিচ থেকে বেডটার ধাক্কার আওয়াজে মায়ের ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল। মা যখন চোখ খুললেন তখন বেডের নিচে কোনো কিছুর থাকার অনুভব করলেন যেন বেডের নিচে কেও রয়েছে। সেদিন মা খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন।
মা যখন এইরকম ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছিল তখন বাবাও ঘুমের কাতরে স্বপ্ন দেখছিলেন -একটি লম্বা , কালো মানুষের ছায়া মূর্তি বাবা মাথা কাছে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে।তখন মায়ের সাথে বাবারও ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। সেইবার থেকে মা-বাবা ছাদে ঘুমাতে সাহস পাইনি।
তারপর তিন-চার মাসের মধ্যে রুমের বাকি তিনটি নার্স ওইখানে থেকে ট্রান্সফার হয়ে চলে গেলেন। তাদের পরিবর্তে আর দুটি নতুন নার্স ওই কোয়ার্টারে রুমে আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু কেজানে তারাও আশ্চর্য ভাবে সেই কোয়ার্টারে থাকতে পারলো না। শেষে ওই কোয়ার্টারে বাবা আর অরূপ কাকায় রয়ে গেলো।
ধীরে ধীরে ফাঁকা রুমগুলো ময়লা হতে হতে , মাকড়সা জাল ঘিরে এক ভুতুরি কক্ষে মতন পরিনত হলো। বিকেলে ঢুকতেই কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে আসত। সামান্য শব্দ টা অনেক বেশি শোনাত।
এমনি এক বিকেল বেলায় আমি অরূপ কাকার রুমে একা বসে কবিতা লিখতে মগ্ন ছিলাম বাবা হাসপাতালে কাজে ছিল। ঠিক তখনি কোয়ার্টারে মেন দরজায় পায়ের হাঁটার শব্দ ,পুরো বুঝতে পারছিলাম কেও চপল পরে কোয়ার্টারে ঢুকল। স্পষ্ট শুনতে পারছিলাম জুতোর আওয়াজটা কোনো ভ্রম নই।আমি ভেবেছিলাম হইত বাবা আসছে তাই নিশ্চিত ছিলাম কোনো সন্দেহ করিনি। কিন্তু যখন শুনলাম পায়ের আওয়াজ টা রুমের দিকে না এসে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল তখনই মনটা খটকা লাগলো যে বাবা উপরে কেন গেল?
আমি রুমে বসেই কান পেতে এক মিনিট মতন অপেক্ষা করতে লাগলাম যে পায়ের আওয়াজ টা কখন নিচে আসবে কিন্তু যখন দেখলাম কারও নিচে নামার টু শব্দটি পেলাম না , আমি দুবার জোরে হাঁক দিলাম 'বাবা' বলে। কোনো উত্তর না আসায় আমি খাতা কলমটা টেবিলের উপর ছুঁড়ে হাওয়ার বেগে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ছাদে উঠে দেখলাম কেউ কোথাও নেই । ছাদের নিচে ধারে পাশে কাওকে দেখতে পেলাম না ।কেও ঝাঁপ দিয়ে দৌড়ে পালালেও খুব দূরে যেতে পারবে না কিন্তু না ...কাওকে পেলাম না।
হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সের একটা ড্রাইভার প্রায় বাবার সাথে রুমে আড্ডা জমাতো আমার মতন সেই ড্রাইভার টারও রুমে একা বসে ছিলেন আর আমার মতোই তারও অবিকল অভিজ্ঞতা হয়েছিল।সেও শুনতে পেয়ে ছিল উপরে যাওয়ার জুতোর আওয়াজটা।
বাবা-মা অনেক বার সেই কোয়ার্টারে থাকাকালীন মাঝরাতে খোলা ছাদের উপরে কারও পায়ের আওয়াজ,কখন ও ঝাড়ু দেওয়ার মতো জোরে জোরে আওয়াজ শুনতে পেতো। এমনি এক রাতে ছাদের উপর থেকে অনেক গুলো ইট্ একসাথে ভাঙার ভয়ানক শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন যেন কারা ইট গুলো মেঝেতে কাছাড় মেরে ভাঙছে। বাবা মা একসাথে টর্চ,লাঠি নিয়ে সাহস করে উপরে উঠে দেখলেন কেও তো নেই; একটি ইটও মাত্র ছিল না।
একদিন অরূপ কাকাকে আমরা জোর করে জিঞ্জেস করলাম , তোমার সাথে এইরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি?তারপর অরূপ কাকা যা বলে ছিল তা অবাক করার মতো। অরূপ কাকা একদিন সন্ধ্যায় সময় duty যাচ্ছে ।
রুমের দরজাটা তালা লাগিয়ে হাসপাতালে দিকে রওনা দিল ওমন সময় কোয়ার্টার থেকে বের হতে হতে দুধওয়ালা বোতলের দুধ নিয়ে হাজির ।
হাতে দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে। অরূপ কাকা হাঁটতে হাঁটতে দুধওয়ালাকে বলে গেল দুধটা রুমে বাইরে রেখে দিতে।
কিছুক্ষণ পর অরূপ কাকা যখন কোয়ার্টারে এল ;দেখলো বোতলের দুধটা রুমের বাইরে রাখা ছিল। উনি বোতলটা নিয়ে রুমে রান্নাঘরে গেল দুধটা গরম করতে সেই তখনই কোয়ার্টারে বাইরে থেকে দুধওয়ালা কন্ঠস্বর এলো, 'দুধটা নিয়ে যাও!'
কাকা গিয়ে দেখে দুধওয়ালা আবার দুধ দিতে এসেছে । অরূপ কাকা আশ্চর্য হয়ে বলল, 'কতবার দুধ দিয়ে যাবে একটু আগেই তো দিয়ে গেলে, বিশ্বাস হচ্ছে না ;দাঁড়াও বোতলটা এনে দেখাচ্ছি!'
এই বলে অরূপ কাকা যখন রান্নাঘরে ঘরে গেল
বোতলটা আর দেখতে পাওয়া গেল না । রান্নাঘর থেকে বোতলটা যেন কর্পূরের মতো উবে গেছিল।
ফিরে এসে লজ্জায় নীরবে আরেকবার দুধটা নিতে হয়েছিল। দ্বিতীয় কথা যখন শুনলাম তখন সব রহস্য সমাধান হয়ে গেল; সেই কোয়ার্টারে পাশে এক রুমে নাকি এক মহিলা আত্নহত্যা করে ছিল তার আত্মার উপদ্রব আজও রয়ে গেছে। আরেকটি ব্যাপার, হাসপাতালটি এখানে তৈরী হওয়ার আগে এই পুরো জায়গাটা নাকি শ্মশান ছিল।
ঘটনাটা অরূপ কাকার মুখ থেকে শোনার পর আমরা সবাই একে ওপরের দিকে চেয়ে থেকে গেলাম।
কোয়ার্টারে এইসব ঘটনা গুলো পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। যদি কোনো ব্যক্তি, পাঠকগনের কাছে এর উত্তর থাকে তবে অবশ্যই দিবেন।
ভূতুড়ে গল্প,
ভূতুড়ে গল্প দেখান,
ভূতুড়ে,
ভূতুড়ে গল্প দাও,
ভূতুড়ে গল্প ভুতুড়ে গল্প,
ভূতুড়ে আয়,
ভূতুড়ে গল্প দেখতে চাই,