এক
০১-০৪-২০২০
গতকাল রাতে অতিমারির শহরে কী কী দেখলাম :
১) সুনসান রাস্তায় ঘাড় গুঁজে কোনও মতে নিজেকে টেনে নিয়ে চলা তিনটে বুড়ো রিকশাওয়ালা । দেখলে মনে হয় টোকা দিলে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে । ঘড়ি বলছে সন্ধে সাতটা বাজে , কিন্তু রাস্তাঘাট দেখে মনে হচ্ছে রাত দেড়টা।
২) কারও সাথে বাজারের ব্যাগ দেখলেই রাস্তার দু'দিক থেকে ছুটে আসছে দলে দলে কুকুর । সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে শুধু ।
৩) চাপ চাপ অন্ধকারে ঢাকা নিস্তব্ধ তাল্পুকুর বাজারের রাস্তা ধরে যেতে যেতে হঠাৎ চমকে গেলাম কঁ কঁর কঁ আওয়াজে । দাঁড়িয়ে গেলাম , দেখতে পেলাম না কিছুই । শুধু বুঝলাম মুরগিগুলোকে বাজারে রেখেই ঝাঁপ ফেলেছেন দোকানি । এই রাস্তায় পরপর মাংসের দোকান । যত এগোলাম, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল । চুরির ভয় নেই ? "প্রশ্ন অনেক উত্তর নেই , এই অসহ্য সময়টাকেই কাঁদতে দে ।" মনে পড়ল সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'রাজকাহিনি' দেখে অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন , দাঙ্গার আবহে , নিশুতি রাতে , জনমানবহীন মেখলিগঞ্জের হাটে খাসি ঝোলে কীভাবে ? ডিটেলের দিকে পরিচালকের নজরের অভাব আছে । চাক্ষুষ করলাম বাস্তবের সাথে কল্পনা কীভাবে মিলেমিশে যায় । কখনও বা কল্পনাকেও ছাপিয়ে যায় ।
আজ সকালে কী দেখলাম :
১) জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে 'পদাতিক এক্সপ্রেস' দাঁড়ানোর দাবিতে লড়ছেন অনেকে । আপাতত ট্রেনটির ঠিকানা আমাদের হেরিটেজ স্টেশনের চার নম্বর লাইন ।
২) বেলা বারোটা । ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে তিনটি বড় বাজারের । রাস্তায় যে ক'জন বিক্রেতা বসে আছেন তাঁরা কেউ কেউ কাকুতিমিনতি করছেন আনাজ নেওয়ার জন্য । কেউ উদাসীন । কেউ রাস্তার ধারে সাজানো দোকানের অস্থায়ী ছাউনির নীচে আধশোয়া । চোখ খবরের কাগজে । আজকের রোদটা বড্ড চড়া ।
৩) অলিতেগলিতে ঘুরছে -- "হরেক মাস্ক কুড়ি টাকা ।" ও ফেরিওয়ালা , আরেকটা মাস্ক দাও , আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই , কিচ্ছু করার নেই ।
এতখানি লিখে ফেলার পরে তপন সিনহার 'আতঙ্ক' ছবির সংলাপ মনে পড়ছে :
"--- এখানে কী হচ্ছে ?
--- সাইকেল সেটিং হচ্ছে ।
--- সাইকেল সুদ্ধু তুলে গঙ্গায় ফেলে দেব ।"
দুই
"ঘরে ঘরে ডাক পাঠাল , দীপালিকায় জ্বালাও আলো
জ্বালাও আলো , আপন আলো , শোনাও আলোর জয়বাণীরে ।"
--- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
০৬ - ০৪ - ২০২০ তারিখে সকালে ব্যারাকপুর স্টেশনের সামনে তোলা ছবি । আগের রাতে অকাল দীপাবলি দেখেছে দেশ । আর পরের দিন আমি দেখলাম এই চত্বরের বাসিন্দা, অর্ধভুক্ত - অভুক্ত মানুষের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন দুই বন্ধু । দেখলাম বিস্কুটের প্যাকেটের একটা বড় বাক্স কীভাবে নিমেষে খালি হয়ে যায় খিদের সামনে । ছবি দেখে মনে হতে পারে , ওঁরা পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে সচেতন নন , কিন্তু সেটা ঠিক নয় । বুভুক্ষু মানুষগুলিকে সেই মুহূর্তে অতিমারি কোভিড'১৯ - এর ভয়াবহতা বোঝাতে পারছিলেন না ওঁরা । এই ছবিতে প্রবীণরা নেই , কারণ তাঁরা ছড়িয়ে - ছিটিয়ে বসে - শুয়ে ছিলেন স্টেশনের মূল চত্বরটিতে । যখন লকডাউন শুরু হয় , তখন স্টেশন চত্বরের বাসিন্দা এই মানুষগুলিকে বের করে দিয়ে , গোটা এলাকাটি ঘিরে দেওয়া হয়েছিল । পরে সম্ভবত মানবিকতার খাতিরে সেই বাধা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে । উপরোক্ত এই দৃশ্য দেখে আমার মনে পড়ছিল 'ছবির দেশে কবিতার দেশে' বইটিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের করা একটি কবিতার অনুবাদ ---
"যে শিশু মানচিত্র ও প্রতিলিপি ভালোবাসে
তার কাছে এই বিশ্ব তার ক্ষুধার মতনই প্রকাণ্ড
ওহ , প্রদীপের আলোয় কতই না বিশাল এই পৃথিবী
স্মৃতির চোখে এই পৃথিবী কতই না ছোট !"
-- শার্ল বোদলেয়ার । (পৃষ্ঠা -- ৮৫ । যে দেশ এই বইয়ের বিষয় , সেই ফ্রান্সও বাচেনি অতিমারির প্রকোপ থেকে ।)
স্কুলের ইতিহাস বই , গল্পের বইয়ে পড়া মহামারির স্মৃতি , মন্বন্তরের স্মৃতি ।
আমি জরুরি কাজেই বেরিয়েছিলাম , কাজ সেরে বাড়িতে ফিরে গেছি । আর পাঁচ জনের মত আমিও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন মেনে চলছি । ছবিও তুলেছি দূর থেকে ।
তিন
টি ভি -তে দেখলাম রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় থুতু দিয়ে নথির পাতা ওলটাচ্ছেন । প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী এ রাজ্যের সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের ভাগীদার হতে একটা গোটা সন্ধেবেলা রাজভবনের সব আলো নিভিয়ে রেখেছিলেন । সার্স - কোভ - ২ -এর এই অতিমারি চলাকালীন, বর্তমান রাজ্যপাল কি পারেন না , অন্তত একটা সন্ধেবেলার জন্য সর্বসমক্ষে থুতুর বিপজ্জনক ব্যবহার বন্ধ করতে ?
চার
'গ্রাম নিয়ে ভয় মোদীর ।' ১২ মে ২০২০
|
|
||
এই খবর অনুযায়ী, পরিযায়ী শ্রমিকেরা গ্রামে ফিরলে করোনা সংক্রমণ বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী । কিন্তু আলাদা করে আমাদের মত গ্রামভিত্তিক দেশে গ্রাম নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া মানে , তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা , বিচার - বিবেচনা ও বিচক্ষণতা নিয়ে সরাসরি সংশয় প্রকাশ করা । যা তাঁদের পক্ষে চরম অবমাননাকর । লকডাউন চলাকালীনই খবরের কাগজে আমরা দেখেছি , কীভাবে গ্রামবাসীরা গ্রামে প্রবেশ - প্রস্থানের মূল পথটি বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে আটকে , সম্মিলিতভাবে বহিরাগতদের গতিবিধিতে কড়া নজর রেখে নিজেদের সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন । আমরা দেখেছি , কীভাবে বাইরে কাজ করতে যাওয়া সংশ্লিষ্ট গ্রামের বাসিন্দারা ভিন রাজ্য বা ভিন দেশ থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে ফিরে এলে , কীভাবে গ্রামবাসীরাই স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাদের নিভৃতবাসে থাকার ব্যবস্থা করে সচেতনতার নজির তৈরি করেছেন । সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল , আজকেরই কাগজে খবর আছে, লকডাউনের মধ্যে গ্রামে শর্ট ফিল্মের শুটিং করতে গিয়ে কতিপয় প্রগতিশীল মহানগরবাসী বসিরহাটের গুলাইচণ্ডী গ্রামের বাসিন্দাদের এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন যে --- "...এত লোক কী করে কলকাতা থেকে গ্রামে শুটিং করতে এলেন ! ওঁদেরই অন্যদের সচেতন করার কথা । সেখানে ওঁরাই আইন ভাঙছেন !"
সুতরাং গ্রাম নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশঙ্কা অমূলক ও অপমানজনক ।
পাঁচ
"এই যে ঊনসত্তরের ঙ" ----- বিশ্ব জুড়ে মানব ইতিহাসের বৃহত্তম লকডাউন চলাকালীন মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রক্তকরবী'র এই সম্বোধনটি । সারা বিশ্ব থেকে এ রাজ্য , অষ্টপ্রহর করোনা ভাইরাসের ব্যাপ্তি এবং মোকাবিলা সম্পর্কে কতগুলো সংখ্যা নাচছে চোখের সামনে । পেট্রোল পাম্পে তেল ভরার সময় যেমন মনিটরে চোখের পলকে কতগুলো সংখ্যা বদলে যায় , ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে একদম সেরকম । মোট করোনা আক্রান্ত - করোনার প্রকোপে মৃত এবং সর্বোপরি অতিমারির আবহেও করোনাজয়ী --- এই তিন ধরণের পরিসংখ্যানের মধ্যে সর্বক্ষণ থাকতে থাকতে কেন যেন মনে হচ্ছে , আসলে ওই সম্বোধনের মতই আমাদের আদতে কোনও ব্যক্তিপরিচয় নেই , নাম -পদবি নেই , আমরা এখন শুধুমাত্র কতগুলো সংখ্যা । সবার অলক্ষ্যে কেউ যেন যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ছড়াটি আবৃত্তি করে চলেছে ---- হারাধনের দশটি ছেলে , রইল বাকি... ... ...!
ছয়
"এ এমন কল / যাতে রাজকার্য হয়ে যায় জল । এর সাহায্যে , রাজভক্তি প্রকাশে নারাজ যে , / তাকে করে তোলা একনিষ্ঠ রাজভক্ত , মোটে নয় শক্ত । " ---- হীরক রাজার দেশে , সত্যজিৎ রায় ।
সম্ভাবনার সূত্র মেনে কল্পনাপ্রবণ মন বলছে , এ গ্রহের দাদা পাল্টাচ্ছে , কোভিড'১৯ - এর হাত ধরে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে ক্ষমতা অক্ষ । বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে এই জল্পনা , যে অতিমারি করোনা ভাইরাস আসলে জৈব মারণাস্ত্র । গোলাগুলি চলবে না , তবু মড়ক লাগার মত লোক মরবে , মরছেও । এই ভাইরাস ছড়ানো কোথা থেকে শুরু হয়েছিল , প্রথম কোন দেশ এই প্রাণঘাতী আক্রমণ সামলে নিয়েছে , প্রতিষেধক তৈরির কাঁচামালের জন্য কোন দেশের কাছে গোটা বিশ্বের নতজানু হতে হবে ------ সব প্রশ্নের একটাই উত্তর -- চিন । অপরাধী কখনও অপরাধের সাক্ষ্য রাখে না । তাই যে ডাক্তার প্রথম এর অস্তিত্বের কথা প্রকাশ্যে এনেছিলেন , তিনি ইতিহাসের নিয়ম মেনে এই রোগেই মারা গেছেন । পরপর কতগুলি ঘটনার কথা মনে করি । ১। এভারেস্টের বেস ক্যাম্প পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করল চিন, সরাসরি খোদার ওপর খোদকারি করতে চেয়ে । ২। প্রকাশ্যে এল অলিম্পিকে চিনের চমকপ্রদ সাফল্যের নেপথ্যের কাহিনি । কাগজে, নির্মম ক্রীড়া প্রশিক্ষণের সময় , যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া নাবালকের ছবি প্রকাশিত হল । জানা গেল , রাষ্ট্র হিসেবে চিন নজর রাখে কোন অপ্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ক্রীড়াবিদ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে । যদি তেমন কোনও খবর থাকে , তবে সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে তাকে বড় করার দায়িত্ব পুরোপুরি নিয়ে নেয় চিন । বাবা -মা'র মতামত সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে , জোর খাটিয়ে । সারা বিশ্ব জুড়ে , বিশেষ করে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে চিনা পণ্যের সমান্তরাল বাজার, অর্থনীতির ক্ষতি তো করছিলই । কিন্তু যাদের কোনও কিছুতেই তর সয়না , তাদের গোটা বিশ্বের বাজারের দখল চাই এবং একবারে, তুড়ি মেরে চাই । সেই কারণেই নবরূপে করোনা ভাইরাসের মারাত্মক বিস্তার ঘটছে ---- এমনটা যদি কল্পনা করে নিই , তবে আশা করা যায় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াতে হবে না !
কিন্তু চিনের এই বিপজ্জনক উত্থান কীভাবে মোকাবিলা করছেন , এই গ্রহের বর্তমান দাদা(রা) ? সেই মানুষকেই গিনিপিগ বানিয়ে । 'এম. আর. এন. এ. --- ১২৭৩' নামের টিকা পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে সোমবার(১৬ - ০৩ - ২০২০) , দুই সন্তানের জননী জেনিভার হ্যালারের দেহে । গিনিপিগের শরীরে ইঞ্জেকশন দেওয়ার ছবিও দেখেছি সবাই । অথচ জানিনা ফল কী হবে ! ওই মহিলা আদৌ বাঁচবেন কি না তারও নিশ্চয়তা নেই । আর আমেরিকায় হওয়া এই বিপজ্জনক পরীক্ষায় সহযোগী হিসেবে জড়িয়ে রয়েছে ভারতও । মনোমোহন মিত্র এমন খবর জানলে হয়ত বলতেন ----- সভ্য হল তারা , সভ্যতার চরম সঙ্কটের সময় যারা মানুষকেই গিনিপিগ বানিয়ে ছাড়ে আর তার নির্লজ্জ প্রচারও করে । সাবাশ !
ভাগ্যিস সেন্টিনেলরা আমাদের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয়না । আমার ধারণা এই বিপর্যয় যদি কাটিয়ে ওঠা যায় , তবে দেখা যাবে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাতি তারাই ।
সাত
সত্যজিৎ রায়ের চারুলতা , নির্জন দুপুরের একাকীত্ব কাটাতে বাড়ির বিভিন্ন দিকের জানলার খড়খড়ি ফাঁক করে , দূরবীন দিয়ে চোখ রাখতেন বিচিত্র সব পসরা বিক্রির হাঁক দিতে দিতে যাওয়া বিভিন্ন ফেরিওয়ালার ওপর । লকডাউন চলাকালীন আমাদের অবস্থাটাও হয়েছে ঠিক তেমনই । বারান্দায় এসে দাঁড়ালেই নতুন এক ধরনের ফেরিওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে , যাঁদের সাথে নোভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । ওঁরা সাইকেল নিয়ে অলিগলিতে ঘুরছেন । সাইকেলের হাতলের সঙ্গে ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মত ত্রিস্তরীয় বাতা লাগানো । প্রতিটি স্তরেই ঝুলছে রঙবেরঙের একাধিক মাস্ক । মাস্কগুলি পারস্পরিক দূরত্ব বিধি বজায় রাখছে না , প্রায় একে অন্যের ঘাড়ে চড়ে বসেছে ! ধীরে ধীরে প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে , সাইকেল আরোহী হাঁকছেন --- “হরেক মাস্ক কুড়ি টাকা ! হরেক মাস্ক কুড়ি টাকা ! এক দাম , দামাদামি করবেন না । কিছু কম হবেনা , কিছু বেশিও হবেনা !” এই দৃশ্য দেখে অতিমারির আবহে , কবীর সুমনের গানটি সামান্য পাল্টে গাইতে ইচ্ছে করছে --- ও মাস্কওয়ালা , আরেকটা মাস্ক দাও ; আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই , কিচ্ছু করার নেই । মুখবর্মও বিক্রি হচ্ছে একইভাবে ।
প্রসঙ্গত , সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী নোনা চন্দনপুকুর এলাকায় কোভিড – ১৯ আক্রান্তের সন্ধান মিলেছে । গোটা রাজ্যে চারটি ঘোষিত হটস্পটের অন্যতম , উত্তর চব্বিশ পরগনায় অন্তরীণ আছি আমরা ।
আট
২০ জুলাই ২০১২ সকালে বাবার টেম্পোরারি পেসমেকার খোলার পর বিকেলে হঠাৎ পরিস্থিতি অতি সঙ্কটজনক হল । চোখ ঘোলাটে , সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে , নিঃশ্বাস - প্রশ্বাস প্রায় বন্ধ । কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি (সম্ভবত ) ডাক্তার মিরাজ মণ্ডল ছুটে এলেন । হ্যাঁচকা টানে সবুজ পর্দা দিয়ে আই সি সি উ - তে বেডের চারদিক ঘিরিয়ে দিলেন । আমাকে বললেন বাইরে বেরিয়ে যেতে । কিন্তু আমি কথা শুনিনি । সিস্টারদের টেবিল থেকে একটা ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ নিলেন আর পাশের স্বাস্থ্যকর্মীকে ঠিক দুটি শব্দে নির্দেশ দিলেন ----- মনিটর , ক্যুইক । বাবার ফতুয়াটা গলা পর্যন্ত উঠিয়ে বাঁ হাতের তর্জনী হৃৎপিণ্ডের ওপর রাখলেন একবার , তারপর সূচটা আমূল ঢুকিয়ে দিলেন ভিতরে । তারপর খুব আস্তে আস্তে টানতে লাগলেন , আর কালচে তরল বেরিয়ে আসতে লাগলো । একবার এরকম করার পরই মনিটর লাগানো হল । ছবিটা পুরোপুরি দেখতে পেলাম সামনে । ততক্ষণে সিনিয়র ডাক্তারবাবুরা এসে গেছেন । আস্তে আস্তে সঙ্কট কেটে গেল । বাবাকে নতুন জীবন দিলেন ডাক্তার মিরাজ মণ্ডল । তিনি আমাদের কাছে দেবতুল্য নন , সাক্ষাৎ দেবতা ।
বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া অনেক ভাল , অবিশ্বাস দিয়ে শুরু করলে সমস্যা জটিলতর হয় । সেদিন মিরাজবাবু এই তথাকথিত ঝুঁকিটা না নিলে কী হত , আর ভাবতে চাইনা ।
দেবানন্দের গাইড ছবিটার , যার কাহিনিকার সম্ভবত সমরেশ বসু , শেষ দিকটা মনে পড়ছে । নায়ক একটি খরাপীড়িত গ্রামে গা ঢাকা দিতে আসে সাধুর ভেক ধরে । ঘটনাচক্রে স্থানীয় মানুষ ধরে নেয় তাঁর কোন অলৌকিক ক্ষমতা আছে । সবাই মিলে তাঁর পায়ে পড়ে আর্জি জানায় , তিনি যেন ভগবানকে বলেকয়ে একটু বৃষ্টি নামিয়ে দেন । নায়ক প্রাণপণ বোঝানোর চেষ্টা করে যে , সে মহাপুরুষ নয় আদৌ , এসব অলৌকিক ক্ষমতা তাঁর নেই । কিন্তু ভক্তবৃন্দ কোনও কথা মানতে নারাজ । চাপে পড়ে নায়ক অনশন শুরু করে এই ভেবে যে , যদি তাঁর জন্য ক'টা প্রাণ বাঁচে , তবে তাই সই । কাকতালীয়ভাবে শেষে সত্যিই বৃষ্টি নামে , এবং নায়ক মারা যায় । লোকে ধরে নেয় এই মহান মানুষটির আত্মত্যাগের জন্যেই এ যাত্রা তারা বেঁচে গেল । এই ছবি একটা মানবিক উত্তরণের গল্প বলে । একজন সাধারণ ভ্রমণসঙ্গী , অনেকের কাছে জীবনের পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন । আমরা এই উত্তরণের গল্পে ভরসা রাখবো ।
https://sankhamanigoswami.blogspot.com/2020/09/pub-9792609886530610.html











