শংকরের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি সত্যজিৎ রায়ের 'জন-অরণ্য'('THE MIDDLEMAN'. A TOUCHING TALE OF HUMANITY) ছবিটি আমার ভীষণ ভাবে সমসাময়িক মনে হয়, যদিও গল্পে সত্তরের দশকের অরাজকতার কথাই বিশেষ ভাবে তুলে ধরা হয় । গল্পের সাথে এই ২০২১ সালের বাস্তবের অনেক মিল আছে । তখনকার মত এখনও বাজারে চাকরির আকাল । চাকরির পিছনে না লেগে থেকে গল্পের নায়ক সোমনাথ(প্রদীপ মুখোপাধ্যায়) ব্যবসা করতে নেমেছে । এই লাইনে পোড় খাওয়া মানুষ বিশুদা(উৎপল দত্ত) হলেন তাঁর নিজের ভাষায় সোমনাথের 'লঞ্চিং প্যাড' ! বিশুদার সাহায্যে সোমনাথ চাঁদে না পৌঁছলেও চাঁদি(টাকা) জোগাড়ের অবস্থায় পৌঁছে যাবে বলে আশ্বাস পায় ! ছবির অনেকগুলো চরিত্র বিখ্যাত --- যেমন বিশুদা , যেমন রবি ঘোষের নটবর মিত্তির । যে দালালি করে খায় কলকাতা শহরে এবং সে ব্যাপারে কোনও রাখঢাক নেই । সে রূঢ় বাস্তবটা খুব ভালভাবে বোঝে এবং সে আদতে দালাল হলেও একজন আদ্যন্ত সৎ ও ভণিতাহীন মানুষ । সিনেমাটায় কতগুলো দৃশ্য ভীষণ ঝাঁকুনি দেওয়ার মত । সোমনাথের প্রেমিকার ছোট্ট চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন অপর্ণা সেন । সোমনাথ চাকরি না পাওয়ায় , অনেক কান্নাকাটির পর তাঁর অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যায় । বিয়ের পরেও সে সোমনাথকে খামে ভরে চিঠি লেখে । ব্যবসার কাজ শেষ করে সন্ধেবেলা বাড়িতে ফেরার পর বন্ধুর মত বউদি ডাকে আসা পুরনো প্রেমিকার চিঠি সোমনাথের হাতে তুলে দেয় । এর পরের দৃশ্যটাই শকিং ! বৌদি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর সোমনাথ চিঠিটা না পড়েই খামটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দেয় এবং ব্যবসা সংক্রান্ত একটা চিঠি খোলে । পুরনো প্রেমিকা তাঁর কাছে অতীত , আর এখন অতীতের কানাকড়িও মূল্য নেই সোমনাথের কাছে । সেটা এখন বুঝি , আগে বুঝতাম না ওটাই বাস্তব ।
ছবির অনেকটা অংশ জুড়ে আছে পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা --- দেহ ব্যবসা । এই প্রসঙ্গে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি । একদিন সন্ধেবেলা লোকাল ট্রেনে ব্যারাকপুর স্টেশনে সবেমাত্র নেমেছি । দেখলাম , পাশের দরজা দিয়ে যে যুবতী নামলেন , তাঁর সঙ্গে দরজায় দাঁড়ানো এক ব্যক্তির খোলাখুলি পাওনা টাকা নিয়ে কথা চলছে , সবার সামনে । সিনেমাতেও এমন কিছু আঘাত করার মত দৃশ্য আছে , যেখানে স্বামী স্ত্রীকে , মা মেয়েদেরকে ভদ্রজনের মুখোশ পরে দেহ ব্যবসায় কাজে লাগিয়ে উপার্জন করছে নির্দ্বিধায় । আপাত অসম্ভব এই ঘটনাগুলোকে এখনও দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের পাশাপাশি রেখে বিচার করলে ভীষণ বাস্তব , ভীষণ অপ্রিয় সত্য মনে হয় , যেগুলো সাধারণত প্রকাশ্যে আলোচনায় আমরা এড়িয়ে যাই ।
সত্যজিতের চিত্রনাট্যের ভাষায় --- "কুছ কাম সিধা , অউর কুছ কাম টেরা , এই নিয়েই হল বেওসা !('অভিযান') কিন্তু কতটা ট্যারা কাজ ব্যবসার স্বার্থে একজন মোটের ওপর নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ বাস্তবে করে উঠতে পারে , এই নিয়ে এখনও আমার মনে প্রশ্ন আছে । এই ছবির শেষে যেমন দেখানো হয়, মরমে মরে গিয়েও দেহ ব্যবসায় নামা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বোনকে সোমনাথ হোটেলের ঘরে এক দামী ক্লায়েন্টের কাছে পৌঁছে দেয় একটা বড় বরাত পাবে বলে । এই দৃশ্যটা নিয়ে আমার মনে এখনও প্রশ্ন আছে । সোমনাথ মধ্যবিত্ত পরিবারে , পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা স্নাতক যুবক । ব্যবসার মই বেয়ে উঠতে গিয়ে, কেউ কী বাস্তবে এতটা নামতে পারে ? প্রশ্ন রয়ে যায় । বন্ধুর বোন , মানে তো ব্যতিক্রম ছাড়া নিজেরও বোনের মত । এতটা কালো কী বাস্তবের সোমনাথদের জীবন হয় ? আমার ধারণা নেই । তবে কথাতেই তো আছে ---facts are stranger than fiction . কাজেই জীবনে পোড় খাওয়া দুই কৃতী মানুষের অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে এই দৃশ্য যখন সামনে আসে, তখন তার দিক থেকে জোর করে মুখ ফিরিয়ে থাকি কী করে ?
https://www.youtube.com/watch?v=VXQVzarS_gs

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.