রিসেপশন
এক প্রাইভেট হাসপাতালের রিসেপশন । এক বৃদ্ধাকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হয়েছে । ছেলে মাকে নিতে এসেছেন । বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে । বার দুই কাউন্টারে জিজ্ঞেস করলেন , আর কি কোনও কাগজপত্র নেওয়ার আছে ? রিসেপশন সুন্দরী বললেন , না স্যর , সবই আপনাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে । তবু ভদ্রলোক বসলেন আমার বাঁ পাশে । আমার ডানপাশ থেকে ওনার মা বললেন , চল , একবারে গাড়িতেই উঠে বসি । ভদ্রলোক দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন । আগেই মনে হয়েছিল , এবার গন্ধে বুঝলাম , দুই হাতে-ঘাড়ে ট্যাটু করা ভদ্রলোক আকণ্ঠ পান করে এসেছেন । ওনার মা একটু থম মেরে বসে আস্তে আস্তে একাই বেরিয়ে বাইরে গাড়িতে উঠে বসলেন । প্রবল গরম , রিসেপশনে পুরোমাত্রায় এ সি চলছে । ভদ্রলোক কিছুক্ষণ ঢুলতে ঢুলতে মিনিট পনেরো পরে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলেন । ওনাকে ড্রাইভার ডাকতে এলো , ডাকতে ডাকতে , ডাকতে ডাকতে স্বাভাবিকভাবেই সাড়া পেলনা । প্রথমে রিসেপশনে গুঞ্জন , যেন জীবনে কেউ মাতাল দেখেনি ! তারপর ডাক পড়ল নিরাপত্তা কর্মীদের । ভদ্রলোকের তখন শরীর ছেড়ে দিয়েছে । জাগাও পথিককে , ও সে ঘুমে অচেতন ! এরপর সুপারভাইজার এলেন , সব শুনে পাক্কা পেশাদারের মত বললেন , ট্রলি ডাকো , ভর্তি করে নাও । ড্রাইভার আমতা আমতা করে কী যেন বলতে বলতে ওনার পিছনে দৌড়ল । আমার ফোনে ঠিক তখনই একটা মেসেজ ঢুকল । ফোনে মেসেজ অ্যালার্ট টিউন বাজছে --- কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায় , ও ভাইরে ... !
হাসপাতালের রিসেপশন হল এমন একটা জায়গা যেখানে সুস্থ লোকেদের কিছু করার থাকেনা ,
কিন্তু অনেকক্ষণ থাকতে হয় । আরেকদিন এক হাসপাতালের রিসেপশনে বসে আছি , সামনে এক মধ্যবয়স্ক
ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রী আমার দিকে পিছন ফিরে বসে । দু’জনের দু’দিকে মুখ , কথা হচ্ছে
না । কিছুক্ষণ পরে পরেই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার দিকে তাকাচ্ছেন , আর কনিষ্ঠা থুড়ি কেনি
আঙুলটা স্ত্রীর বাঁহাতে ছোঁয়াচ্ছেন । স্ত্রী রাগতভাবে তাকিয়ে বুড়ো আঙুলটা দিয়ে ওনার
কেনি আঙুলটাকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছেন । এ জীবনে নীরব ভালবাসার ভাষা তেমনভাবে শেখা হয়ে
ওঠেনি । অনেক ভেবে মনে পড়ল ছোটবেলায় থুতনির নীচে বুড়ো আঙুল ঘষে যার ওপর রাগ হত, তাকে
আড়ি করতাম । আর প্রেমিক-প্রেমিকারা যে নিজেদের কনিষ্ঠা আঙুল জড়িয়ে পাশাপাশি হাঁটে সে
তো দেখিই । আমি ওনাদের সাইন লাঙ্গোয়েজ এইটুকুই ডি-কোড করতে পেরেছি ।
তৃতীয় ঘটনাটা
কলকাতার শিশুমঙ্গল হাসপাতালের । চারটে থেকে ছ’টা ভিজিটিং আওয়ার চলছে । আমাদের সামনের
বেডের ভদ্রলোকের পেটের পাশের দিকে একটা ফুটো দিয়ে নল ঢোকানো , সেখান দিয়ে পেটের ভিতরের
ফ্লুইড জমা হচ্ছে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে , ঠিক ক্যাথিটারের মত । ভদ্রলোকের স্ত্রী
ওনাকে দেখতে এসেছেন । কথা থামিয়ে ভদ্রলোক হঠাৎ বলে উঠলেন – এনেছো । স্ত্রী ঘাড় নাড়লেন
। ভদ্রলোক বললেন – দাও । তারপর ওঁর স্ত্রীর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে যেটা বেরোল , তা দেখে
আমাদের চক্ষু চড়কগাছ । তেল চুপচুপে ঠোঙায় চারটে শিঙাড়া ! ভদ্রমহিলা ওয়ার্ডের দরজায়
গিয়ে দাঁড়ালেন, নার্সরা কেউ টহল দিতে আসছেন কিনা খেয়াল রাখতে । আমরা বুভুক্ষুর মত ভদ্রলোকের
শিঙাড়া খাওয়া দেখে হাসব না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না । আমার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের
লেখা , বিকাশ রায় অভিনীত ‘আরোগ্য নিকেতন’ ছবিটির একটি মজাদার অথচ মর্মস্পর্শী দৃশ্য
মনে পড়ছিল । মশায়বাবার চিকিৎসাধীন এক রোগীর জটিল পেটের ব্যামো কিন্তু ভীষণ খাওয়ার লোভ
। মশায় বারবার করে তাকে বলে দিয়েছেন ওষুধ-পথ্যের বাইরে কিচ্ছু না খেতে । শেষে দেখেন
তাঁরই বাড়িতে পুজো উপলক্ষে যে ভিয়েন বসেছে , তার পাশে , একটু আড়ালে গিয়ে গাণ্ডেপিণ্ডে
গিলছে সেই রোগী । মশায় তাকে দেখতে পেয়ে ভীষণ রেগে বলে ওঠেন --- তোর এত লোভ , বারবার
বারণ করা সত্ত্বেও তুই আমার কথা শুনলি না ! তোর মৃত্যু কেউ আটকাতে পারবেনা । স্থানীয়
লোকে বিশ্বাস করতো , মশায়ের নিদান কখনও মিথ্যে হয়না । সেদিন এতটা না হলেও কোনও ডাক্তারবাবু
নিশ্চয়ই ওই ভদ্রলোককে শিঙাড়া খেতে দেখলে বলতেন—মিছিমিছি একটা বেড আটকে রাখছেন কেন
? বাড়ি চলে যান । আর মনে মনে হয়ত বলতেন , আপনার রিজার্ভেশন কনফার্মড !

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.