মাটির গন্ধ
(১)
গিটারটা মাথার ওপর দিয়ে খুলতে খুলতে সৌরীশ
বলল --- “নাহ , উই আর মিসিং সামথিং ইয়ার ! হোয়ার হ্যাভ অল দ্য ফ্লাওয়ার্স গন , প্রবাল
?”
--- “ঈপ্সিতারা কমন রুমে গেছে । কিন্তু
তুই জিমনাসিয়ামের বারান্দায় বসে , একা একা কাকে গান শোনাচ্ছিলি ?”
--- “বলছি , এই মিঠুন , ডান দিকে সর তো
একটু । এখানে বসলে মেন গেটের দিকে নজর রাখা যাবে । মনীষা আসলে দেখতে পাব । এবার তোর
কথার উত্তর দিই । ওখানে গিয়ে একা একা বসে গান গাইছিলাম , কারণ আমি একটু একা থাকতে চাইছিলাম
। ডু ইউ নট থিঙ্ক , আমরা আজকাল বড় বেশি কথা বলছি , সরবে এবং নীরবে , ফোনে এবং ফেসবুকে
? এত কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে বড্ড হাঁপিয়ে উঠি । আজকাল সন্ধেবেলার দিকে কখনও কখনও
রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম গিয়ে গর্ভগৃহের পিছনের দিকে চুপচাপ ঘণ্টাখানেক চোখ বন্ধ করে বসে
থাকি । সন্ধ্যারতি হয়ে যাওয়ার পর , ওই যে পিন ড্রপ সাইলেন্স --- ওটা মন আর মগজের পক্ষে
বড্ড আরামদায়ক , কপালে মায়ের হাত বোলানোর মতন । আচ্ছা মিঠুন , তোরও কী মনে হয় না ,
আমাদের বন্ধু-বান্ধবীদের চোখের তারাগুলো আজকাল কেমন অস্বাভাবিকরকম চঞ্চল ?”
--- “আমি তোর মত ভাবুক নই । আর তোর মত
ইন্টেলেক্টও আমার চোয়ালে এসে জমা হয়নি , অতয়েব আমি ইন্টেলেকচুয়ালও নই । তবে হ্যাঁ
, দ্য ফার্স্ট পার্ট অব ইওর স্পিচ ইজ কোয়ায়েট রেলেভ্যান্ট । ইয়েস , উই আর মিসিং সামথিং
। কী যেন একটা , খুব কাছাকাছিই আছে , কিন্তু ধরতে পারছিনা , বুঝতে পারছিনা । মনের ভিতর
কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা আছে আর সেটাকে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মত খুঁজতে খুঁজতেই
আইপডে শ’য়ে শ’য়ে গান শোনা , গার্লফ্রেন্ডের সাথে তিস্তার স্পারে বসা আর সারাদিন ধরে
ঘরে-বাইরে প্রচুর অদরকারি কাজে ডুবে থাকা আছে । এই আমাদের কথাই ধর , দু’দিন বাদে থার্ড
ইয়ারের রেজাল্ট বেরোবে , আস্তে আস্তে আমরা কাজের জগতে হারিয়ে যাব , হয়তো বা নিজের মধ্যে
থেকেও হারিয়ে যাব । এ সি কলেজের আনাচকানাচে এভাবে মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ে বেড়ানোটাকে
মিস করব ভীষণভাবে । অথচ দেখ , এখনও পর্যন্ত আমরা রিয়েলাইজই করে উঠতে পারছিনা , আল্টিমেট
সুখটা ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে , কিসে পাওয়া যাবে !”
--- “ঠিক তাই ।“ মিঠুনের কথার সূত্র ধরে
প্রবাল বলল --- “অ্যাপারেন্টলি আমাদের কোনও অভাব নেই । আমাদের বাবা-মা’দের যে প্রজন্ম
তাঁরা এত নিরুদ্বেগে-নিশ্চিন্তে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পাননি , সেদিক থেকে তো আমরা সৌভাগ্যবান
। অথচ বুকের ভিতর কখনও কখনও ডিপলি ফিল করি , কোথায় যেন একটা নোঙর ফেলা বাকি । বুকের
ভেতর থেকে কে যেন মাঝরাতে ফিসফিস করে বলে যায় , এই বেলা খুঁজে নাও , এই জীবন থেকে পরিপূর্ণভাবে
তুমি ঠিক কী চাও । জীবনটাকে তুমি চালাবে , না জীবন তোমাকে । রাশ তোমার হাতে থাকবে
, নাকি জীবনের গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে , অসহায়ভাবে মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা
দিতে থাকবে যে , যাক , জীবন যেমন চায় , যেদিকে চায় , আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাক । জীবন
হোক বেলাগাম ।“
--- “এই , আমরা বড্ড বেশি দার্শনিকের
মত কথা বলছি । ছাড় তো । জাঁকিয়ে শীত পড়েছে কিন্তু আজ । টেম্পারেচার কততে নামল আজকে
? শিলিগুড়িতে তো চার না পাঁচ বলল খবরে ।“ উত্তর পাওয়ার অপেক্ষা না করেই মিঠুন আবার
বলল --- “কালই তো বড়দিন । আচ্ছা , থার্টি ফার্স্টে পিকনিক করতে গেলে হয়না মূর্তি কিংবা
রোহিণীতে ?” ওর গলায় আনন্দ মেশানো উত্তেজনার ছোঁয়া ।
--- “বাস পাওয়া যাবে ভেবেছিস ! কুট্টিরা
কালীঝোরা যাবে বলে একমাস আগে থেকে কালুসাহেবের একটা বাস বুক করে রেখেছে । তাছাড়া এত
তাড়াতাড়ি সবকিছু অরগানাইজ করা যাবেনা । চাঁদা তোলার ব্যাপার আছে , মেয়েদের বাড়িতে কনভিন্স
করানোর ব্যাপার আছে । তার চেয়ে বরং কাছেপিঠে কোথাও চল । লাল মন্দির গেলে হয়না ? নদী
আছে , চা বাগান আছে , দারুণ জায়গা” --- বলল শুভার্থী । এতক্ষণ ও চুপচাপ বসে বাকিদের
কথা শুনছিল ।
--- “ঠেলা ভাড়া করতে হবে , বাসনকোসন
, চ্যালা কাঠ আর রান্নার জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য । ঠেলাওয়ালা এই সময়ে সুযোগ বুঝে
অনেক টাকা ভাড়া হাঁকবে । তাছাড়া যেতেও অনেক সময় লাগবে । তার চেয়ে বরং করলা ভ্যালি চা
বাগানটা সিলেক্ট কর । কলেজের কাছেই হবে । আমরা সবাই সুবোধদার দোকানের সামনে সকালে মিট
করব , তারপর একসঙ্গে যাব । এগ্রিড ?” বলল সৌরীশ ।
ওর অকাট্য যুক্তি মেনে নিয়ে সবাই মিলে
করলা ভ্যালি চা বাগানেই পিকনিক করতে যাওয়া স্থির হল । কিছুক্ষণ পর নবনীতা , ঈপ্সিতা
, মনামিরা কমনরুম থেকে ফিরলে ওদের সঙ্গে আলোচনা করে বাজেট আর মেনুও ঠিক হয়ে গেল । চাঁদা
ও পিকনিক স্পট নিয়ে বান্ধবীরা ওদের সঙ্গে সহমত । কেবল একটাই শর্ত , রান্নার দায়িত্ব
একা মেয়েরা নেবে না , ছেলেদেরও হাত লাগাতে হবে । ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কেবল ফটো
তুললেই চলবে না । হাত পুড়িয়ে রাঁধতে হবে না , এই-ই ঢের । এই শর্তে কেউ অরাজি হয় ! ছেলেরা
সমস্বরে বলল --- তথাস্তু !
(২)
ঠিক ছিল সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে সবাই
কলেজের মেন গেটের সামনে সাইকেলে পৌঁছবে । রান্নার জিনিসপত্র কলেজপাড়ার এক বন্ধুর বাড়িতে
রাখা থাকবে । একটা ঠেলা জোগাড় করা হয়েছে । ঠেলাওয়ালা নয় , ওরাই কলেজ থেকে করলা ভ্যালি
পর্যন্ত সেটাকে ঠেলেঠুলে চালিয়ে নিয়ে যাবে ঠিক হয়েছে । ওইটুকু তো মাত্র পথ । কথামত
আগে-পরে সবাই পৌঁছে গেল । স্নান করে আসতে হয়েছে বলে সবাই অল্পবিস্তর কাঁপছে । কাঁধ
উঁচু করে হাতের চেটো ঘষছে । চারদিকে ঘন কুয়াশা । কথা বলতে গেলেই মুখ দিয়ে সবার ধোঁয়ামত
বেরোচ্ছে । সবার মুখে হাসি । ওরা অপেক্ষা করছে উত্তমের জন্য । ওদের মুরগির ফার্ম আছে
। মাংসের ব্যবস্থাটা ও-ই করবে । ছাড়িয়ে-কাটিয়ে আনতে হবে বলেই সম্ভবত ওর একটু দেরী হচ্ছে
। সব রেডি , ও আসলেই সবাই বেরিয়ে পড়বে ।
সাড়ে আটটা নাগাদ একটা বাজারের ব্যাগ সাইকেলের
হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে উত্তম যখন হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির হল , তখনও আকাশের মুখ ভার । দেখেই
বোঝা যায় , আজ রোদ ওঠা মুশকিল আছে । পিকনিকের পক্ষে একেবারে আদর্শ দিন ! একটু পরে কুয়াশা
কেটে যাবে কিন্তু হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডাটা কমবে না । রান্না বসিয়ে , সেই আগুনেই হাত সেঁকে
নেওয়া যাবে । পরপর গোল করে সাজিয়ে উনুন তৈরি করার জন্য মেন গেটের উল্টোদিকে সুবোধদার
দোকানের সামনে কিছু ইট এনে রাখা ছিল । দোকানটা জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি মেন রোড থেকে একটু
নীচুতে । ঢাল বেয়ে নামতে গিয়ে হিম ভেজা ঘাসে দু’একজনের পা পিছলে গেল । মনীষা গলা ছেড়ে
গাইছে --- “দো নয়না অর এক কাহানি / থোড়া সা বাদল , থোড়া সা পানি / অর এক কাহানি ।”
আরতি মুখার্জির এই গানটা সত্যিই মনির গলায় খোলে ভাল , মনে মনে ভাবল সৌরীশ । মিঠুন ডাকল
--- “এই শুভার্থী , এদিকে আয় , জলের ড্রামটা একটু ধর , ঠেলায় তুলে দিই । সবাই যখন এসে
গেছে , তখন আর দেরী করে লাভ নেই । ওখানে গিয়ে মাংসটা ধোওয়া আছে । তাছাড়া মাঝেমাঝেই
যেরকম দমকা হাওয়া দিচ্ছে , তাতে উনুন জ্বালিয়ে রাখা কঠিন হবে । আয় আয় , দেরী করিস না
। অ্যাই দীপঙ্কর , একদম ইয়ার ফোন বের করবি না । আরে ইয়ার , দিনটা এনজয় কর , গাছের থেকে
নীচের শুকনো পাতাগুলোতে টুপটুপ করে ঝরে পড়া শিশিরের শব্দ শোন । আজকে প্লিজ কানে ওটা
গুঁজে রাখিস না । জিনিসটা বড্ড ইরিটেটিং বাড়ির বাইরে এলে ।“ দীপঙ্কর জিন্সের প্যান্টের
ডান পকেট থেকে ইয়ার ফোনটা বের করতে গিয়েও মিঠুনের ধমক খেয়ে বাধ্য ছেলের মত সেটা আবার
স্বস্থানে ঢুকিয়ে রাখল !
ওরা রওনা দিল । ঠেলা সঙ্গে থাকবে , তাই সবাইকে
সাইকেল নিয়ে হেঁটে যেতে হবে । উত্তম আস্তে আস্তে ঠেলার প্যাডেলে চাপ দিচ্ছে । সৌরীশ
গিটার বাজিয়ে কবীর সুমনের একটা গান ধরল --- ‘কতটা পথ পেরোলে, তবে পথিক বলা যায়’ । সৌরীশ
গলা ছেড়ে গাইছে , সবাই চুপ । দু’একজন মাঝে মাঝে ঠোঁট নাড়িয়ে কথাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে
শুধু । মোহিতনগরের দিক থেকে শহরে কাজের খোঁজে ঢুকছে যে লোকগুলো , তারা সৌরীশের দিকে
তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে যাচ্ছে । জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি রুটের বাসের জানলা দিয়ে মুখ
বার করে অনেকে কৌতূহলী চোখে দেখছে ছেলেমেয়েগুলোকে ।সৌরীশ সে সব কিছুই খেয়াল করছে না
। নিজের মনে গাইতে শুরু করলে , বিশ্বচরাচরের সব কিছু ওর চোখের সামনে থেকে মুছে যায়
।
একটু পরে , ওরা যখন ঢুকছে করলা ভ্যালি চা
বাগানে , তখন কুয়াশা অনেকটাই কেটেছে । হাওয়ার দাপটও কমেছে খানিকটা । সামনের দিকে আদিগন্ত
তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায় । চারদিকে উঁচু-নীচু ঢেউ খেলানো চা বাগান ধীরে ধীরে নেমে গেছে
করলা নদীর খাতের দিকে । নদী পেরিয়ে ওপারে আবার সবুজ ঢেউয়ের বিস্তার । মাঝখান দিয়ে চা
বাগানের বুক চিরে এঁকেবেঁকে অল্প গভীর খাতের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে করলা নদী । নদীর
দু’পাশে বেশ খানিকটা জায়গা পর্যন্ত বালি জমে আছে । বর্ষাকালে নদী এই পর্যন্ত উঠে আসে
দিব্যি বোঝা যায় বালির ওপর পড়ে থাকা বড় গাছের
শুকনো ডাল আর ছোট ছোট বোল্ডার দেখলে । নদীর তীরে বালির ওপর এখানেই ওদের রান্নার ব্যবস্থা
হবে । দু’পাশে চা গাছের সারি , আর তার মাঝে চাপা রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে ওরা দেখল
, প্রায় প্রতিটি চা পাতার বেঁকে আসা শীর্ষবিন্দুটিতে মুক্তোর মত জমে রয়েছে শিশিরের
কণা । নদীর দু’পাশেই চা বাগানের মধ্যে কিছুটা দূরে দূরে চা গাছগুলির মাথায় ছাতা ধরার
মত দাঁড়িয়ে রয়েছে বড় বড় মোটা গুঁড়ির গাছ ।
প্রবালের ফটোগ্রাফির শখ আছে , ওর ডি এস এল
আর ক্যামেরা সচল হয়ে উঠেছে । তাই ও একটু একটু করে পিছিয়ে পড়ছে ওদের দল থেকে । সেটা
লক্ষ্য করে ঈপ্সিতা গলা তুলে ওকে ডাকল --- অ্যাই প্রবাল , তাড়াতাড়ি আয় , পরে ছবি তুলিস
। আয় এখন একসঙ্গে যাই । আজ বিকেল পর্যন্ত আমরা সবাই একসাথে থাকব , একা ঘোরাঘুরি চলবে
না ।
--- “যথা আজ্ঞা ম্যাডাম !” প্রবাল পিঠের
ব্যাগে ক্যামেরা পুরে ফেলল । নদীর পাড়ে পৌঁছে একটু পরিষ্কার মত একটা জায়গা বেছে নিয়ে
রান্নার তোড়জোড় শুরু হল । ওরা তিনটে দলে ভাগ হয়ে গেল । এক দল গেল নদীর পাড়ে মাংস ধুতে
, একদল ইট সাজিয়ে পাশাপাশি দু’টো উনুন তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । আর মেয়েরা বালির ওপর
চাদর পেতে বসলো ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করতে । সঙ্গে ফ্লাস্কে করে সবার জন্য চা বানিয়ে
এনেছে নবনীতা । সবার জন্য ডিম-পাউরুটি-মাখন আর কলা আনা হয়েছে । রান্নাটা চাপিয়ে দিয়েই
জঠরাগ্নি কিছুটা প্রশমনের ব্যবস্থা করতে হবে । কেউই অত সকালে খেয়ে আসেনি , তাই সকলের
পেটেই ছুঁচো দৌড়চ্ছে !
(৩)
উনুন এবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে ।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবাইকে উঠতেই হল । আলু-ফুলকপি কেটেকুটে আনাই হয়েছে , কলেজ পাড়ার বন্ধুটির
বাড়িতে বসে মেয়েরা এসব করেছে কাল সন্ধেবেলায় । এতগুলো মানুষকে রান্না করে খাওয়ানোর
দায়িত্ব নিয়েছে বলে ঈপ্সিতা –নবনীতারাও আজ যেন একটু বেশি বড় বড় ভাব করছে ! রান্নাবান্নার
ব্যাপারটা যত এগোবে , ছেলেরা জানে , এই ভাব তত বাড়বে ! কিন্তু আজ আর এসব নিয়ে মেয়েদের
কেউ ঘাঁটাবে না । দীপঙ্কর , ঈপ্সিতাকে শুধু বলতে গিয়েছিল , বকফুল আর চাটনিটা শেষে করার
কথা । ওরা ওকে ব্যসন ফেটিয়ে দেওয়ার কথা বলাতে আমতা আমতা করছে দেখে মজা পেয়ে বাঁ হাতটা
তুলে মিঠুন বলল --- “চিন্তা করিস না , আমি ওটা করে দেব । এবার আয় , সবাই ব্রেকফাস্টটা
সেরে নিই । প্রায় সাড়ে দশটা বাজে ।“
(৪)
খাওয়াদাওয়া শেষ হতে হতে প্রায় সওয়া তিনটে
বাজল । ঘড়ির কাঁটা পাঁচটার ঘর পেরোলেই ঝুপ করে অন্ধকার নামবে , তাই ওরা সবাই মিলে এবার
ঘুরতে বেরোল । কাছাকাছি একটা চায়ের কারখানা আছে , সেটা দেখে ওরা নদীর কোল ঘেঁষে হাঁটবে
কিছু দূর অব্দি , এমনটাই ঠিক হয়েছে । এসব জায়গায় তো আর একা একা চট করে আসা হয়না , তাই
যতটা পারা যায় সবাই ঘুরে দেখে নিতে চাইছে । স্থানীয় দু’জন লোক , ওরা যখন খাচ্ছিল এক
পঙক্তিতে বসে , তখন দূরে বসে জুলুজুলু চোখে তাকিয়েছিল । ওদের ডেকে পেট পুরে খাইয়ে সঙ্গের
জিনিসপত্র আর সাইকেল পাহারায় বসিয়ে আসা হয়েছে । এইসব আদিবাসীরা খুব বিশ্বাসী হয় , তাই
জিনিসপত্র খোয়া যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই । হাঁটতে হাঁটতে সবাই রান্নার প্রশংসা করছে
। করবেই , কারণ প্রত্যেকেই কব্জি ডুবিয়ে আঙুল চেটে খেয়েছে । মেয়েরা বাড়িতে কত রান্না
করে , সবাই জানে ! কিন্তু আজকের পরীক্ষায় ওরা একেবারে ডিসটিঙ্কশন পেয়ে পাশ করেছে ।
সঠিক স্বাদ বজায় রেখে এতগুলো মানুষের জন্য রান্না করা কি চাট্টিখানি কথা ! আসলে মনটা
আনন্দে থাকলে , তাজা থাকলে , সব কাজই ভালভাবে উতরে যায় । চায়ের কারখানায় কাণ্ড-কারখানা
দেখে ওদের তাক লেগে গেল । এক জায়গায় ছোটখাটো একটা পাহাড়ের মত স্তূপ করে রাখা বাগান
থেকে আনা চা পাতা , আর এক জায়গায় ওরা দেখল একটা কনভেয়ার বেল্টের উপর দিয়ে চা পাতা পাঠিয়ে
দেওয়া হচ্ছে একটা বাক্স মতন যন্ত্রে । পাতাগুলো সেখান থেকে কুচিকুচি হয়ে বেরিয়ে আসছে
। ওদের সবার গায়ে গরম জামা , সোয়েটার , চাদর । অথচ ওদের দেখে খারাপ লাগল , যারা কারখানায়
কাজ করছে , তারা প্রত্যেকেই পাতলা-শতচ্ছিন্ন জামাকাপড় পরে রয়েছে । অথচ লোকগুলো এত পরিশ্রম
আর কষ্টের মধ্যেও হাসতে ভোলেনি । কাজ করতে করতেই রসিকতা করছে পরস্পরের সাথে । সকালবেলা
ঘুম ঘুম চোখে যে উষ্ণ তরলে সবাই সরু করে ঠোঁট ছোঁয়ায় , সেটা গৃহস্থের ঘরে ঘরে পৌঁছে
দেওয়ার পথে যে কত মানুষের শ্রম লুকিয়ে থাকে !
কারখানা থেকে বেরিয়ে ওরা নদীর ধারে বালির
ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় একটা সরু বাঁকে , নদীর জল একটু কম দেখে , নদী পেরিয়ে
গেল ওপারে । বাঁ হাতে চটিজোড়া নিয়ে পায়ের পাতা ডোবা , হাড় হিম করা ঠাণ্ডা জলের মধ্যে
দিয়ে নদী পেরোতে গিয়ে ওদের সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল । এ পাশটায় লোকজনের যাতায়াত
আরও কম , তাই পাখির সমাবেশ আরও বেশি । চা-বাগানের মাঝে বড় গাছগুলিতে শ’য়ে শ’য়ে পাখির
কলরবে জায়গাটা ভরে আছে । এত সুরেলা , এত মধুর সিম্ফনি ওরা কেউ আগে শোনেনি । প্রবাল
চা-গাছগুলোর মাথায় বসে থাকা ছোট ছোট নানা রঙের পাখির ছবি তুলতে তুলতে ভাবছিল , প্রকৃতিতে
যে এত রঙ আছে , রঙের এত বৈচিত্র্য আছে , তা-ই তো জানা ছিলনা এতদিন । সেই লাইনটা মনে
পড়ে যায় --- দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া , ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া , একটি ধানের…
, থুড়ি চা পাতার ওপর , একটি শিশিরবিন্দু !
এর মধ্যে কখন যে দিনের আলো নিভে এসেছে
কেউই খেয়াল করেনি । এখনই কালো পর্দার মত অন্ধকার নেমে আসবে আর চা-গাছগুলোকে ঘিরে এল
ই ডি আলোর মত থোকায় থোকায় জোনাকি জ্বলে উঠবে । এই জায়গাটা তখন সেজে উঠবে অন্য এক রূপে
। দু’একটা জোনাকি ইতিমধ্যেই এদিক-ওদিক থেকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে
। তার সঙ্গেই খুব মৃদু হলেও শুরু হয়েছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক । এবার ওদের ফিরতে হবে । আবার
সেই বাগানের ঢাল বেয়ে নেমে আসা , আবার সেই নদী পেরনো । এপারে এসে ওরা বালির ওপরে চটি
হাতে খালি পায়েই হাঁটছিল । ভিজে পায়ে চটি পরে বালির ওপর দিয়ে হাঁটা যায়না । টুকটাক
কথা বলতে বলতে ওরা বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছে , চিন্তা করছে ওই লোক দু’টো এখনও ওদের জিনিসপত্রের
কাছে বসে আছে কিনা তাই নিয়ে । এমন সময় সৌরীশ হঠাৎ পিছন ফিরে দৌড়ে গেল নদীর দিকে । ডান
হাত দিয়ে জলের সামনে থেকে কী যেন একটা খামচে তুলে নিয়ে , দৌড়েই ফিরে এল আবার । সৌরীশ
অল্প হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের সামনে এসে মুঠো খুলল । বন্ধুরা দেখল সৌরীশের হাতে এক তাল
ভেজা মাটি । কেউ কোনও প্রশ্ন করার আগেই ও হাতের মুঠো মুখের খুব কাছে এনে, চোখ বন্ধ
করে জোরে একবার শ্বাস নিল । তারপর বলে উঠল --- “এই গন্ধটাই তো হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম
এতদিন ধরে ।“ সৌরীশের কথায় এক অদ্ভুত তৃপ্তির
সুর ফুটে উঠল, যা ওর বন্ধুরা আগে কোনওদিন শোনেনি । অথচ সবাই নিমেষে অনুভব করল , সৌরীশের
কথাটা কোথায় যেন লুকিয়ে ছিল সবার বুকের ভিতরে ।
----------------








