বছর দেড়েক আগেকার ঘটনা ।
প্রতিদিনের মত বাবা সন্ধেবেলা হাঁটতে বেরিয়েছেন । সাধারণত ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই
ফিরে আসেন । কিন্তু সেদিন আড়াই ঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার পরও আসছেন না । এবং এই সময়টায়
মোবাইল ব্যবহারে বাবার ভীষণ অনীহা । এটা বাবার একা থাকার সময় । এদিকে বাড়িতে
উৎকণ্ঠায় আমাদের আধমরা অবস্থা । তৃতীয়বার হারা উদ্দেশ্যে খুঁজতে বেরোবার ঠিক আগে
বাবা ফিরে এলেন । গেট দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতে মায়ের অনিবার্য প্রশ্নবাণ ধেয়ে এলো --- “কোথায়
গিয়েছিলে ? এত দেরী হল কেন ?” বাবা শান্তভাবে বাইরের দরজাটার ছিটকিনি তুলে মায়ের
মুখোমুখি হয়ে , স্মিত হেসে উত্তর দিলেন --- “শ্মশানে গিয়েছিলাম । এখানকার
ব্যবস্থাপনা কেমন , দেখে এলাম । কয়েকদিন পরেই তো যেতে হবে । তখন তো আর দেখতে পাব
না কীভাবে কী হয় !” উত্তর শুনে মা – ভাই কাঁদো কাঁদো । কিন্তু আমি হেসে ফেলেছিলাম
মৃত্যু সম্পর্কে বাবার এই অদ্ভুত উদাসীনতা দেখে । মুখে যে যাই বলুক , মৃত্যু
সম্পর্কে সবার মনেই অল্পবিস্তর ভয় থাকে । মরতে কে চায় হঠকারী ছাড়া ? আমি তো চাই না
এখনও পর্যন্ত । “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে / মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই
। … … … তা যদি না পারি তবে , বাঁচি যত কাল / তোমাদেরই মাঝখানে লভি
যেন ঠাঁই । / তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল / নব নব সঙ্গীতের কুসুম ফুটাই । /
হাসিমুখে নিয়ো ফুল , তারপরে হায় / ফেলে দিয়ো ফুল , যদি সে ফুল শুকায় ।“ (‘প্রাণ’ ,
‘কড়ি ও কোমল’ , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) । বাবা নিজে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন বলেই
বারবার বলতেন – “ভালো মন্দ যাহাই আসুক , সত্যেরে লও সহজে ।“ ছোট থেকে বাবার মুখে
কথাটা শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল । সেই কারণেই বোধহয় সেদিন হেসে ফেলেছিলাম ।
বাবা বৈদ্যুতিক চুল্লি সেদিনের আগে দেখেননি ।
কিন্তু একান্ত পারিবারিক গল্প হঠাৎ বলছি
কেন ? সেটা এবার বলবো । ২৪ অক্টোবর বাবা চিরদিনের মত আগুনের গুহায় ঢুকে গেলেন । ক’দিন
আমরা কৃচ্ছ্রসাধন করলাম । কয়েকদিন যানবাহনে ঘোরাফেরার সময় অভিনব অভিজ্ঞতা হল ।
প্রথম দিন আমি একা অটোর পিছনের সিটে বসেছি , আরও দু’জনের জায়গা খালি । লক্ষ্য
করছিলাম থামাবার জন্য হাত দেখিয়েও যেই আমার দিকে চোখ যাচ্ছে , সবাই কবীর সুমনের
ভাষায় --- “তাক করে উদাসীন , আকাশকুসুম টিক টিক …” করে ইচ্ছাকৃত ভাবে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন । অটোওয়ালার
ডাকে সাড়া দিচ্ছিলেন না । এরকম কয়েকবার হওয়ার পর , কিছুটা অপরাধ বোধ থেকেই ওনাকে
বললাম --- “আমি কি সামনে গিয়ে বসবো ? আমার মনে হচ্ছে আপনি অনেকগুলো ভাড়া মিস করছেন
।“ ভদ্রলোক মুখে হাসি টেনে বললেন – “আপনি পিছনেই বসুন ।“ এরপর পাঁচ মিনিটও হয়নি ,
একজন অভিজাত চেহারা ও পোশাকের মধ্যবয়স্ক মহিলা অটো থামালেন , তারপর উঠতে গিয়ে
আমাকে দেখে পরিষ্কার করে বললেন --- “তোমার অটোতে অশৌচ আছে । যাব না ।“ স্বাভাবিক
ভাবে আমার খুব কান্না পাওয়া উচিত ছিল , কিন্তু পেল না । বরং বেদম হাসি পেলো । শেষ
পর্যন্ত সিটও খালি থাকলো না অবশ্য ।
অশৌচ মানে অপরিষ্কার , অপরিচ্ছন্ন ,
অপবিত্র । নিজের পবিত্রতা সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই । তবে চুল – দাঁড়ি – নখ
ছাড়া তো মোটামুটি পরিচ্ছন্নই ছিলাম ! এই কয়েকদিনের জন্য সমাজ যে পোশাক ঠিক করে দেয়
, সেটাই পরেছিলাম । তা সত্ত্বেও আমি পরিত্যজ্য হলাম কেন ? যে হিন্দু সমাজ এই সময়ে
কিছু নিয়ম পালনের কথা বলে , সেই সমাজই আবার আংশিক ভাবে ব্যক্তিবিশেষ কে বর্জনও
করবে --- এটা স্বাভাবিক ? এ তো সমাজ কর্তাদের চূড়ান্ত স্ববিরোধিতা । যখন মানুষের
মন খুব দুর্বল থাকে , তখন নিয়মের নিগড়ে তাঁকে মানসিকভাবে বারবার আঘাত করার বিভিন্ন
রীতি বর্জনীয় বলে মনে হয়েছে প্রতি পদে । অবশ্য এই কয়েকদিনে বিভিন্ন জায়গায় আশাতীত
ভালো ব্যবহারও যে পেয়েছি , সেই কথাটা না বললে অন্যায় হবে ।
কয়েকদিনের জন্য হলেও ‘দ্য আনটাচেবল’ হয়ে
বাঁচতে কেমন লাগে , সেটা কিছুটা বুঝলাম । আজ বাদে কাল ন্যাড়া মাথায় চুল গজিয়ে যাবে
, আমি মিশে যাব জনারণ্যে । কিন্তু অস্পৃশ্য হওয়ার অভিজ্ঞতা আমৃত্যু মনে থাকবে ।
সমস্ত পারলৌকিক কাজে ‘প্রেত’ শব্দটা
বারবার ঘুরেফিরে আসে কেন ? আমাদের বাবাকে ‘প্রেত’ ভাবতে যাব কেন ? এ তো চরম মানসিক
অত্যাচার । মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা । ক্লাস ফাইভে এক বছর হিন্দি ছিল , আর সেভেন – এইট
দু’বছর সংস্কৃত । যে সব মন্ত্রগুলো বললাম , তার বেশির ভাগেরই মানে পুরোপুরি বুঝলাম
না , সঠিক উচ্চারণও করলাম না । শুধু অনুকরণ করে ঠোঁট নাড়িয়ে গেলাম । কেন ? কেউ কেউ
বিছানায় বসার উপক্রম করতেই চেয়ার এগিয়ে দিলেন ! কেন ? সবচেয়ে বড় কথা , অশৌচান্তে
সমাজস্বীকৃত আয়োজনের ব্যবস্থা করতে বেশ পরিশ্রম করতে হয় । প্রায় অনাহারে থেকে
শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত পরিবারের পক্ষে সে কাজ সম্পূর্ণ সুস্থভাবে করা কী
আদৌ সম্ভব ? এখন এত কথা বলছি , কারণ অপ্রিয় সত্যি কথাটা হল --- “প্রতিবাদী
কণ্ঠগুলো টাকার ব্যাপার / প্রতিবাদ করতে গেলেও খাবারদাবার ।“
আজকাল বিয়ের বা অন্যান্য সামাজিক
অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পত্রের নীচে অনেকে পরিষ্কার লিখে দেন --- “দয়া করে সঙ্গে
কোনও উপহার আনবেন না ।“ ব্যক্তিগতভাবে আমার এটা ভীষণ অপমানজনক মনে হয় নিমন্ত্রিতের
পক্ষে । নেমন্তন্ন যখন করলেনই , তখন তিনি আসবেন কি না , খাবেন কি না , উপহার আনবেন
কি না ---- সেটা তাঁর উপরেই ছেড়ে দেওয়া ভালো । নইলে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ
করা হয় । আমার তো যে কোনও উপহার পেতে দারুণ লাগে , দিতেও । কিন্তু তাই বলে
শ্রাদ্ধবাসরে উপহার ! আগে অন্যদের ক্ষেত্রে দেখেছি , এবার আমাদের বেলায় ঘটলো ।
অনেকেরই শ্রাদ্ধের খাবারে অরুচি থাকে । বেশিরভাগ নিমন্ত্রিত রজনীগন্ধার মালা ,
স্টিক , বড়জোর সঙ্গে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যান । জলপাইগুড়িতে বড় হয়েছি , বরাবর
এমনটাই দেখেছি , করেছি । দক্ষিণবঙ্গে আজকাল দেখছি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানেও অনেকে উপহার
নিয়ে আসেন । এসেছেন । এই আবহে কি উপহার মানায় ? সর্বোপরি ব্যাপারটা কী লেনদেনের
পর্যায়ে চলে যায় না ? ফোন করে নেমন্তন্ন ও নগদ উপহার – দু’টোই সমানভাবে বর্জনীয়
বলে মনে করি । না হলে এই দুইয়ের চাপে পড়ে সামাজিকতার পরিসরটা মাঝখান থেকে ভ্যানিশ
হয়ে যায় । হবিষ্যান্ন কিনে আনার সময় না – ই থাকতে পারে , তাতে অসুবিধে নেই ।
কিন্তু এ বাবদ মূল্য ধরে দেওয়াটা বড্ড গায়ে লাগে । আর এমন একটা উদ্দেশ্যে এটা করা
হয় , যে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রিফিউজও করা যায় না কড়া ভাবে । ওই মুহূর্তে সেটা করলে
অন্যেকে অপমান করা হয় , স্বর্গতকেও । রাজদ্বারে শ্মশানে চ য তিষ্ঠত স বান্ধব । কেউ
কাউকে ধন্য করছে না , দয়া করছে না , করুণা করছে না , কৃতার্থ করছে না বা উদ্ধারও
করছে না --- এই কথাটা মনে রাখা দরকার ।
অনেকে হয়ত বলবেন , তা এতই যখন হাসি পায়
, তখন এত সব সামাজিক রীতি মানলেন কেন ? সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিলেই তো পারতেন । তাঁরা
ঠিকই বলবেন । আসলে এমন একটা ঘটনার অভিঘাতে কয়েকদিন তর্ক করার শক্তিটুকুও হারিয়ে
ফেলেছিলাম । কয়েকটা দিন কেটেছে যন্ত্রচালিতের মতন । উঠতে বললে উঠেছি , বসতে বললে
বসেছি । এখন ক্রমেই পিতৃবিয়োগের শোকও সহনীয় হয়ে উঠছে । একটা সম্বোধন জীবন থেকে
হারিয়ে গিয়েছে শুধু --- বাবা ।
-------------------------
https://sankhamanigoswami.blogspot.com/2020/11/pub-9792609886530610_98.html
'চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম' ওয়েবজিনে প্রকাশিত
অশৌচ পালনের নিয়ম
অশৌচ কত প্রকার
অশৌচ শব্দের অর্থ

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.