পঁচিশ বছর আগেকার কথা । মামাবাড়িতে ঘুরতে বোলপুরে এসেছি । অবশ্য এখানে আসার সেটাই একমাত্র কারণ নয় , হাতে কিছু কাজও আছে । আর সেগুলো নিয়েই খুব ছোটাছুটি করতে করতেই দু’তিন দিন কোথা দিয়ে যে বেরিয়ে গেল , টেরই পেলাম না । যাইহোক নির্দিষ্ট দিনে ফেরার জন্য রাতের খাওয়া সেরে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়ালাম । আমার সঙ্গে আছে একটা সুটকেস আর একটা শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ । খোঁজ নিয়ে জেনেছি , ট্রেন বেশ খানিকটা লেটে চলছে । প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কয়েকজন যাত্রী । আমি একমনে উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মের দেওয়ালে বহুবার দেখা বিরাট টাইলসের ম্যুরালটা দেখছি । কতক্ষণ এভাবে তাকিয়েছিলাম খেয়াল নেই । হঠাৎ বাঁদিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম , গেট পেরিয়ে স্টেশনে ঢুকছে এক ক্ষীণকায়া তরুণী । চোখে চশমা , চলাফেরার ভঙ্গী খুব চটপটে । পরনে একখানা বাটিক প্রিন্টের লাল রঙা সালোয়ার-কামিজ । একই রঙের ওড়নাখানা গলার দু’পাশ দিয়ে নেমে গেছে পিঠের দিকে । আমার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে আসাতে দেখলাম , দু’গালে বেশ কিছু ব্রণের দাগ আছে । মেয়েটি আহামরি কিছু সুন্দরী নয় , তবে চেহারায় সজীবতা আছে , স্নিগ্ধতা আছে । চোখের ভাষায় স্পষ্ট পড়া যায় বুদ্ধির ছাপ । মেয়েটির দু’হাতে দু’টি ব্যাগ । সঙ্গে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এসেছেন ।
কিছুক্ষণ বাদে ট্রেন এলো । সঙ্গের ভদ্রলোকটির
তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও দেখলাম , মেয়েটি নিজেই ভারী ব্যাগ দু’টো বয়ে কামরায় উঠল । আমার
সাথে , একই কামরায় । বোলপুরে দার্জিলিং মেল খুব অল্প সময় দাঁড়ায় । মেয়েটির সাথে যে
ভদ্রলোক এসেছিলেন , তিনি ব্যস্তভাবে মেয়েটির বার্থ নম্বর খুঁজতে লাগলেন । আর আমি তাঁর
পেছন পেছন ধীরে ধীরে, ইতি-উতি তাকাতে তাকাতে এগোতে লাগলাম । শেষে দেখা গেল , একই কুপেতে
প্যাসেজের মধ্যে আমার আপার বার্থ , বিপরীত দিকে লোয়ার বার্থটি সেই মেয়েটির । ট্রেন
হুইসল দিচ্ছে এবার । আমি তখনও ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে । আমার বার্থটা ফাঁকা পেয়ে একজন মোটাসোটা
ভদ্রলোক সেটার দখল নিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন । তাঁর নিদ্রাভঙ্গের জন্য খুব গলা ফাটাচ্ছি
– এমন সময়ে পাশ দিয়ে দরজার দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে যেতে , সেই মেয়েটিকে ট্রেনে তুলে
দিতে যিনি এসেছিলেন , তিনি বেশ জোরেই বললেন --- “রাতের গাড়ি… … …একসঙ্গেই যখন যাচ্ছ
ভাই… … একটু দেখো ।“ ঘাড় নেড়ে সম্মতিসূচক ভঙ্গী করতে গিয়ে মেয়েটির দিকে চোখ পড়ল । ভ্রূকুটি
দেখে বুঝলাম , ভদ্রলোকের এই অনুরোধটি মেয়েটিকে বিশেষ সন্তুষ্ট করতে পারেনি । এটাই তো
স্বাভাবিক । প্রত্যেকটা মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে ভালবাসে । মেয়ে হলেই যে নিজের দায়িত্ব
নিজে নিতে পারবেনা --- এরকম একটা ধারণা করা তো ভুল । ভদ্রলোক এরপর তাড়াতাড়ি টা – টা
গুডবাই করে নেমে পড়লেন । ট্রেন দুলকি চালে চলতে শুরু করল । এতক্ষণ খেয়াল করিনি , কিন্তু
এবার মনে হল মেয়েটি বোধহয় আমার সমবয়সীই হবে । কিছুক্ষণ পরে যখন চেকার এলেন , তখন সব
সংশয়ের অবসান হল । আমি চেকারের পাশে ইচ্ছে করেই দাঁড়িয়েছিলাম , টিকিটের মধ্যে বয়সের
অঙ্কটা স্পষ্ট চোখে পড়ল । নীচের সিটে মেয়েটির একখানা সুটকেস তখনও খাড়াভাবে রাখা ছিল
। তাতে দেখলাম বড় বড় করে ইংরেজি হরফে লেখা একটি নাম --- মৌমিতা চ্যাটার্জি । চটপট সঙ্গের
জিনিসপত্র ঠিকঠাক মত গুছিয়ে রেখে শোওয়ার ব্যবস্থা করে , যে যার জায়গায় চলে গেলাম ।
ঝড়ের বেগে ট্রেন ছুটতে শুরু করেছে । কামরার ভেতরটা নীল আলোয় প্রায়ান্ধকার ।
চুপচাপ শুয়ে আছি , বেশ গরম লাগছে ।
জামার উপরের দু’টো বোতাম খুলে দিলাম । কিছুটা সময় কাটল , কিন্তু কেন জানিনা কিছুতেই
দু’চোখের পাতা এক করতে পারছিনা । ডানদিকে কাত হয়ে নীচের দিকে তাকালাম । চুম্বকের মত
চোখ টানছে একটি নারী শরীর । মেয়েটি বুক পর্যন্ত একটা পাতলা চাদর টেনে , ডানহাতটা চোখের
ওপর আড়াআড়িভাবে রেখে চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে । জানলা দিয়ে আসা দমকা হাওয়ায় মাঝেমধ্যেই সরে
যাচ্ছে আবরণ । একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটির ফর্সা মুখের দিকে । মেয়েটিকে পক্কবিম্বাধরোষ্ঠী
বলা যেতেই পারে । বারে বারে চোখ যেতে লাগল অল্প ফাঁক করা , যেন তৃষ্ণার্ত ঠোঁট দু’টোর
দিকে । এ মুখ আমার যেন খুব চেনা , এমনটা মনে হতে লাগল বারবার । আমি কোনও মহাপুরুষ নই
যে চোখ ফিরিয়ে নেব , তবু একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় মনে হল , এভাবে তাকিয়ে থাকাটা
উচিত হচ্ছেনা । আচমকা চোখে চোখ পড়ে গেলে , সেটা দু’জনের পক্ষেই চরম অস্বস্তির ব্যাপার
হবে । পাশ ফিরে শুলাম কিছুটা অনিচ্ছা নিয়েই । নিজের অজান্তে কখন যেন ঘুমে দু’চোখ জড়িয়ে
এল ।
যখন ঘুম ভাঙল , তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে
। রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পৌনে আটটা বাজে । অর্থাৎ নিউ-জলপাইগুড়ি পৌঁছোবার
আর বেশি দেরী নেই । নেমে এসে চোখ-মুখে জল দিয়ে এসে জানলার ধারে মেয়েটির মুখোমুখি বসলাম
। জানলা দিয়ে আসা হাওয়ার ঝাপটা ধীরে ধীরে দূর করে দিচ্ছে আমার শরীর ও মনের সমস্ত জড়তা
। জানলার বাইরে প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট । কিছুক্ষণ বাদে , পাশে বসা সেই
মোটামত ভদ্রলোকটি নিজে থেকেই আলাপ জমালেন । বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা চলতে লাগল তার সাথে
। মেয়েটি বাবু হয়ে বসে একখানা পেপারব্যাক ইংরেজি গল্পের বই পড়ছিল সিডনি শেলডনের । হঠাৎ
বই থেকে মুখ তুলে কয়েক মুহূর্ত সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে , আমার বকবকানি শুনতে
লাগল । তারপর উপরের ঠোঁট দিয়ে নীচের ঠোঁট চেপে গম্ভীরভাবে জানলার দিকে একপলক তাকিয়ে
, আবার বইয়ে মনোনিবেশ করল । আরও কিছুক্ষণ বাদে , নির্ধারিত সময়ের বেশ কিছুটা পরে ট্রেন
এন জে পি পৌঁছল । আমি হেলতে –দুলতে ট্রেন থেকে নেমে এসে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালাম
। জিনিসপত্র নিয়ে মেয়েটিও এগিয়ে এলো আমার দিকে । তারপর ব্যস্তভাবে বলল ---“চার নম্বরে
লোকাল ট্রেনটা এখনও আছে বোধহয় । তাড়াতাড়ি চল , না হলে আর জায়গা পাব না । জলপাইগুড়ি
পর্যন্ত দাঁড়িয়েই যেতে হবে ।“
আমরা দু’জনে একসাথে ওভারব্রিজের দিকে
এগিয়ে গেলাম !













