অনেক চেষ্টা করেও সেদিন
বাড়ি ফেরার শেষ ট্রেনটা ধরতে পারলাম না । যুগপৎ হতাশ ও ক্লান্ত হয়ে
প্ল্যাটফর্মে চোখ বুজে বসেছিলাম । খেয়ালই করিনি আশেপাশে আর একটিও লোক নেই । আর পি
এফের এক কনস্টেবলের গলায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ খুলতেই হল । বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে
। যাওয়ার পথে বারবার চারপাশটা দেখছিলাম । সদা ব্যস্ত শিয়ালদা স্টেশনের এমন
পাণ্ডববর্জিত রূপ আগে কখনও দেখিনি । আমি বেরোতেই মেন কলাপ্সেবল গেটেও তালা পড়ে গেল
। বাইরে সিঁড়ির কাছে যে যার মত শোয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছে কাগজ অথবা কাপড় বিছিয়ে ।
কোনওমতে শেডের নীচে একফালি বসার জায়গা পেলাম । আমার মতন আরও কয়েকজন আশেপাশে বসে
আছেন । একটু পরে বাইকে করে দু’টো লোক এসে কয়েক মুহূর্ত থেমে , কেন কে জানে সবার
মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে গেল । যে বাইক চালাচ্ছিল , তার পরনে লুঙ্গি আর
স্যান্ডো গেঞ্জি , গলায় মোটা সোনার হার । পিছনে একটা যান্ত্রিক শব্দ পেয়ে
প্ল্যাটফর্মের গেটের কাছে গিয়ে দেখি , ঝাড়া – সাবান জল দিয়ে ধোয়া ও মোছার কাজ শুরু
হয়েছে একপাশ থেকে । মেন লাইনে প্রথম ট্রেন শুনলাম ভোর তিনটের পরে । আর চুপ করে বসে
থাকতে ভালো লাগছিল না । হাঁটতে বের হলাম । বিদ্যাপতি সেতুর নীচে মাত্র একটা পানের
দোকান খোলা । বৈঠকখানা বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম । শুনেছিলাম বাজারের
পণ্যবাহী ট্রাকগুলো বেশি রাতের দিকে ঢুকতে শুরু করে । তাই বোধহয় বেশ কিছু মুটে
চোখে পড়লো । মোবাইলে দেখলাম সওয়া একটা বাজে । খিদেয় পেট চুই চুই করছে । সন্ধানী
চোখ শুঁটকি মাছের দোকানগুলোর কাছে ঠিক একটা রুটি – তড়কার দোকান খুঁজে বের করল ।
দু‘জন মাতাল আর তিন জন মুটে বেঞ্চে বসে রাতের খাওয়া সারছে । গরম গরম ডিম – তড়কা আর
রুটি নিয়ে বসে গেলাম ওদের পাশে । “সমস্ত মেহনতি মানুষ এক হও” --- স্লোগানটা মনে
পড়ে যাচ্ছিল । কিন্তু আমি তো নেহাতই সৌখিন মজদুরি করি ! একবারে কুড়ি কিলো ওজনও আমি
ওদের মত অনায়াসে মাথায় বয়ে নিয়ে যেতে পারব না । তাই পাশে বসেও আসলে আমি ওদের থেকে
কয়েক আলোকবর্ষ দূরে । একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আরও একটু এগোলাম নামী গয়নার
দোকানগুলোর দিকে । সেই সময়েই রাস্তার ডানদিকে চোখে পড়লো মহিলাকে । আলোআঁধারিতে
একটা বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন । পাশে একটা সুটকেস । আর কেউ নেই । পরনে
পাটভাঙা দামী তাঁতের শাড়ি এবং রীতিমত অভিজাত চেহারা । এইসময়ে এইজায়গায় একদম
বেমানান । এই এলাকায় রাত একটু গভীর হওয়ার দিকে এগোলেই যাঁদের ঢল নামে বন্ধ দোকানের
সামনে , তাঁদের মত অপুষ্ট , বহুকাল অনিদ্রায় ভোগা চেহারা নয় , সস্তা লিপস্টিক নয় ,
রুজ নয় । স্বল্প প্রসাধনে স্নিগ্ধরূপা । এবং মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মত সুন্দরী । চোখ
ফেরাতে পারছিলাম না হাঁটতে হাঁটতে । স্বাভাবিক প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরছিল – রাতদুপুরে
ইনি এভাবে এখানে কেন ? ঠিক সামনেটা দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হল । তিনি
একটি বিশেষ ইঙ্গিত করে চোখ টিপলেন । যা বোঝার বুঝে গেলাম ! অথবা অনেক কিছুই বুঝলাম
না , জানলাম না । ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল , কারণ সামনে একদল কুকুর তাদের এলাকায়
অনুপ্রবেশকারীর দিকে প্রবল গর্জনে ছুটে আসছে । এই সময়ে পিছন ফিরে দৌড়লেই সর্বনাশ ।
ওরা একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে । ভয়- উত্তেজনা চেপে শান্তভাবে স্টেশনের দিকে হাঁটা
লাগালাম । এবার সামনে আরেকটা হার্ডল। এক পুলিশ অফিসার বাইক নিয়ে যেতে যেতে আমাকে
দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন । কিছু বললেন না , কিন্তু টের পেলাম পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়
আগাপাশতলা জরিপ করলেন । বিদ্যাপতি সেতুর নীচটা দিয়ে যাওয়ার সময় পিছনে ফিরে দেখলাম
বাইক স্ট্যান্ড করে স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকেই চেয়ে আছেন । স্টেশনের সিঁড়িতে এসে
বসার পাঁচ – দশ মিনিটের মধ্যেই খবরের খোঁজে পুলিশ আধিকারিকদের সাথে কথা বলতে
শুনলাম দু‘একজন সাংবাদিককে । তার পরেই একের পর এক ঢুকতে শুরু করল দৈনিক খবরের
কাগজের গাড়িগুলো । বেশ কয়েকটা করে প্যাকেট নামছে , আর ঠেলাওয়ালা এবং কাগজের
প্রতিনিধির সঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে মেপে ফাঁক করা গেট দিয়ে শিয়ালদার ভিতরে । ব্রাউন
কাগজে মোড়া প্রত্যেকটা প্যাকেটের ওপর কাগজের নাম , স্টেশনের নাম বড় বড় হরফে লেখা ।
কিছুক্ষণ পরে স্টেশনে ঢুকে দেখি , দক্ষিণ ও প্রধান শাখায় কাকভোরের প্রথম ট্রেনগুলি
বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়ার জন্য তৈরি । আর প্রতিটি ই এম
ইউ লোকাল ট্রেনের স্টেশনের দিকের প্রতিটি দরজার একটা দিকে মেঝে থেকে ছাদ অবধি তৈরি
হয়েছে একাধিক কাগজের প্যাকেটের স্তম্ভ । কামরার বাকি অংশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে
আছেন গোয়ালারা । সিটের নীচে কাপড় দিয়ে ঢাকা ছানার প্লেট আর দরজার সামনে দুধের মস্ত
ধাতব পিপে । এটা হল আপলোড করার পর্ব । পরে একাধিক বার দেখেছি প্রতিটি স্টেশনে পণ্যগুলি
ডাউনলোড করার জন্য রাত জেগে বসে থাকে একটা বিরাট টিম । কয়েক সেকেন্ডে হাতে হাতে
নেমে যায় জিনিসগুলি । তারপর শুরু হয় বণ্টনের জন্য ধাপে ধাপে তৈরি হওয়া । যেমন
কাগজের ভিতরে অবিশ্বাস্য দ্রুত হাতে লিফলেট ঢোকানো । ভোর তিনটের পরপর যখন ট্রেন
ছাড়ল , তখন দু‘চোখ ঘুমে বুজে আসছে । একটা সিট পুরো ফাঁকা , জানলা দিয়ে ফুরফুরে
হাওয়া আসছে । সহযাত্রীকে গন্তব্য বলে শুয়ে পড়লাম । এই তো জীবন কালীদা ! আর কী চাই
!
স্টারি নাইট উলফ । শিল্পী : ভ্যান গঘ ।
https://sankhamanigoswami.blogspot.com/2020/10/pub-9792609886530610_39.html
<script async src="https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-9792609886530610"
crossorigin="anonymous"></script>
ফিচার প্রতিবেদন
ফিচার নিউজ
ফিচার পাতা
ফিচার সংবাদ
ফিচার রাইটিং
ফিচার লেখা

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.