চিরকুট
অর্ক আর যূথিকা
দু’জনেই পঁয়তাল্লিশ নম্বরের ! এ সি কলেজে ওরা বাংলা সাম্মানিক স্নাতক স্তরের দ্বিতীয়
বর্ষের পড়ুয়া । আর ওই বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরের নম্বরটি হল পঁয়তাল্লিশ
। সৈয়দ মুজতবা আলির ‘দেশে – বিদেশে’ মনে পড়ছে ? ঠিকই ! কী নিয়ে পড়ছো , এই প্রশ্ন কেউ
করলেই এই বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা উত্তর দেয় ---- “আমি এখন পঁয়তাল্লিশ নম্বরের !” পলিটিকালি
কারেক্ট থাকা আরকি ! দু’জনের খুব বন্ধুত্ব , একসাথে কলেজে যায় , মাঠে আড্ডা দেয় , সুবোধদার
দোকানে খায় , পড়তে যায় । ক্লাসেও সম্ভব হলে পাশাপাশিই বসে । সবাই ভাবে ওরা চুটিয়ে প্রেম
করছে , কিন্তু সেটা ঠিক না । ওরা আসলে খুব ভাল বন্ধু । বিশ্বচরাচরের এমন কোনও বিষয়
নেই , যা নিয়ে ওদের গল্প হয় না । যূথিকা সুন্দরী , বিদুষী । স্বল্প প্রসাধনে স্নিগ্ধরূপা
। তাই প্রতিদিনই হয় কলেজের , নয়ত বাইরে থেকে আসা কোনও না কোনও ছেলে যূথিকাকে প্রেম
প্রস্তাব দেয় এবং নিয়ম করে সে , সেইসব প্রস্তাব পত্রপাঠ উড়িয়ে দেয় । শুধু তাইই নয়
, মোবাইলে নোট করে রাখে কত তম প্রস্তাব , কে, কোন তারিখে দিল ! তবে এই হিসেবের ব্যাপারটা
জানে একমাত্র অর্ক । শহরে ও বন্ধুমহলে ওদের প্রেম নিয়ে জল্পনা আরও জোরালো হয় । এবং
সেটা নিয়ে ওদের দু’জনের মধ্যে হাসাহাসি বাড়ে ।
এভাবেই
স্বতঃস্ফূর্ততার চেনা খাতে বয়ে চলছিল ওদের জীবনটা । জন্মদিন বলে সেদিন যূথিকা একটু
বেশি খুশি খুশি স্বাভাবিকভাবেই । মনটা আনন্দে থাকলে , ভাল থাকলে, মানুষকে দেখতে ভাল লাগে । সেই ছাপ পড়ে তার মুখে এবং বিশেষ করে
চোখে । ফলে আজ যেন ওকে ডানা মেলা বহুবর্ণ প্রজাপতির মত লাগছে । আজ যেন মুনি ঋষিদেরও
মতিভ্রম হবে ওকে দেখলে । ঘিয়ে রঙের একটা সালোয়ার – কামিজ যূথিকার খুব প্রিয় । আজ ও
সেটাই পড়েছে । বুকের ওপর ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের মত নেমে এসেছে একই রঙের ওড়না । আর ওর
দুই ভ্রূর মাঝখানে একটা ছোট্ট টিপ , যেন কেউ কালো কালির ডট পেন দিয়ে এঁকে দিয়েছে ।
এমন মুগ্ধতা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার মতন বেরসিক অর্ক
নয় । তাই সবার অলক্ষ্যে, দোতলার করিডরের রেলিঙে
হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সময় , সে অন্য প্রান্তে লাইব্রেরির দিক থেকে পেখম তোলা ময়ূরের
মত হেঁটে আসা যূথিকার চোখে চোখ রেখে ডান হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুল ছুঁইয়ে তারিফ করার
মুদ্রা দেখাল । লাজুক হেসে উত্তর দিল যূথিকা । ইতিমধ্যে তন্বীদি এসে পড়ায় , ওরা তড়িঘড়ি
ঢুকে পড়ল ক্লাসে । আজ অর্ক , যূথিকার ঠিক পিছনে বসেছে । তন্বীদির এখন পঁয়তাল্লিশ মিনিটের
দু’টো পিরিয়ড পরপর । প্রথমটা নির্বিঘ্নেই কাটল । তারপরেই ঘটল সেই বিপত্তি । প্রজাপতির
মতন উড়তে উড়তে যূথিকা খেয়ালই করেনি পিঠের চেনটা কখন আলগা হয়ে গেছে । ওর ছটফটানির চোটে
চেনটা এই মুহূর্তে ওর কোমরের কাছে নেমে এসেছে । যূথিকার গম রঙা পিঠ আর বক্ষবন্ধনীর
দিকে এখন ওর পিছনে বসা সব ছেলের তৃষ্ণার্ত চোখ । অর্ক নিজেও চোখ ফিরাতে পারছিল না সেদিক
থেকে । টের পাচ্ছিল নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছে । কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই অন্য বন্ধুদের লুব্ধ
চোখের দিকে নজর পড়তেই , কেমন যেন একটা অস্বস্তি শুরু হল অর্কর । যূথিকার যে সম্ভ্রমহানি
হচ্ছে সম্পূর্ণ ভাবে নিজের অজান্তে । সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে ও কিছুতেই চুপ করে
বসে থেকে এমনটা হতে দিতে পারেনা । অর্ক কয়েক মুহূর্ত সময় নিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে ।
তারপর কর্তব্য স্থির করে ডায়েরির একটা সাদা পাতার অর্ধেকটা ছিঁড়ল । তারপর সবার চোখের
আড়ালে লিখল ---
“তোর পিঠের চেনটা গোটাটা নেমে গেছে ।
একটু দেখে নে ।“ চিরকুটটা ভাঁজ করে চাপা গলায় যূথিকাকে ডাকল অর্ক । ও মুখ ফিরাতেই এগিয়ে
দিল সেটা । একবার চোখ বুলিয়েই যূথিকা প্রথমে শান্ত ভাবে চিরকুটটা ঢুকিয়ে রাখল ভ্যানিটি
ব্যাগের ভিতরে । তারপর দ্রুত গুছিয়ে নিল নিজেকে ।
সেদিনের পরে আর কখনও ওদের দু’জনের মধ্যে
এই নিয়ে কোনও কথা হয়নি । অর্ক জানেনা প্রেম প্রস্তাবের হিসেব রাখার মত , যূথিকা চিরকুটটাও
সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে কিনা । তবে ওদের বন্ধুত্ব এখনও অটুট রয়েছে ।
অণুগল্প
অণুগল্প কাকে বলে

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.