‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির শুটিং চলছে দার্জিলিঙে । মনীষা
নামে যে চরিত্রটি , তাঁর বার্ড ওয়াচার মামার হাতে বিভিন্ন পাখির পরিচিতি বিষয়ে লেখা
একটা ইংরেজি বই । পাহাড়ি সান্যালকে পাখি খোঁজার দৃশ্যটি বুঝিয়ে বলছেন সত্যজিৎ রায় ।
এমন সময়ে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক , যিনি ম্যালের বেঞ্চে বসেছিলেন অনেকক্ষণ , উঠে এসে সত্যজিৎকে
ক্রমাগত একই প্রশ্ন করতে লাগলেন কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর । সাদামাটা জিজ্ঞাসা --- কী পাখি
খুঁজছেন পাহাড়ি সান্যাল ? সত্যজিৎ যতই হিমালয়ান বার্ড, হিমালয়ান বার্ড বলে , কাজের
সময়ে উটকো ঝামেলা হিসেবে লোকটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন , লোকটার কৌতূহলও যেন ততই
বেড়ে চলেছে । অথচ শট নিতে দেরি করলে চলবে না । শুটিঙের রুটিন ভাঙা একেবারেই সত্যজিতের
স্বভাববিরুদ্ধ ব্যাপার । উপায়ান্তর না দেখে সত্যজিৎ অনিল চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে বললেন
--- “তুমি একটু ম্যানেজ করো ।“ বীরবিক্রমে ‘ম্যানেজ’ করতে গিয়ে , বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার
মত ছিটকে আবার পরিচালকের কাছে ফিরে এলেন অনিলবাবু । তারপর চাপা গলায় যা বললেন , তাতে
ইউনিটের সবার চোখ কপালে ওঠার জোগাড় ! ওই ‘উটকো লোকটি’র নাম সালিম আলি , বিখ্যাত পক্ষী
বিশারদ । পাহাড়ি সান্যাল হাতে যে বইটি ধরে শট দিচ্ছেন , সেটি তাঁরই লেখা ! কাগজপত্রে
পড়েছেন সত্যজিৎ রায় পারফেকশনিস্ট । তাই তাঁকে সাধ্যমত সাহায্য করতে চেয়েই বারবার জানতে
চাইছিলেন , চরিত্রটি কী পাখি খুঁজছে । কারণ, দার্জিলিঙের কোন এলাকায় , কখন , কোন পাখির
দেখা মেলা সহজ , সে ব্যাপারে তাঁর ‘কিঞ্চিৎ’ পড়াশোনা আছে ! সবটা শুনে সত্যজিৎ স্বগতোক্তি
করলেন --- “সব্বনাশ !”
সত্যজিতের শৃঙ্খলাবোধ সম্পর্কে একটি ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতার কথা বলি । বছর দশ – বারো আগে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে সত্যজিৎ রায়ের শুটিঙের
সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত বিভিন্ন জিনিস নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন সন্দীপ রায়
। আমি যখন যাই , তখন ললিতা রায় ঘরে ছিলেন , বেশ কিছু অজানা তথ্য জানতে পেরেছিলাম ওঁর
কাছ থেকে । যেমন, মরুভূমির কাছে ‘সোনার কেল্লা’ ছবির শুটিং করার ফাঁকে আর্ট পেপারের
ওপর নীল কালির ঝর্না কলম দিয়ে আঁকা পাগড়িওয়ালা – বৃদ্ধ উটওয়ালার মুখ । এই ছবিটির কাছেই
ছিল হলুদ আর্ট পেপারের ওপর সত্যজিৎ রায়ের নিজের হাতে তৈরি করা ‘সোনার কেল্লা’ ছবির
শুটিং শিডিউল । যতদূর মনে আছে আটাশ দিনে গোটা ছবির শুটিং শেষ করার পরিকল্পনা করেছিলেন
পরিচালক । এ জিনিস আগে একমাত্র দেখেছি স্কুলে । স্যরেরা নতুন ক্লাসে উঠলে ঠিক এভাবে
তৈরি রুটিন বলে যেতেন । মাথা নত হয়ে গিয়েছিল অসাধারণ নিয়মানুবর্তিতা দেখে । গোটা আর্ট
পেপার জুড়ে স্কেল দিয়ে টানা অসংখ্য খোপ । লম্বা করে তৈরি করা প্রতিদিনের শুটিঙের আগাম
পরিকল্পনা , তারিখ এবং সময়ের উল্লেখ – সহ । যেমন , এত তারিখ , সকাল আটটার থেকে বারোটা
এই শট , রোদ যখন মাথার ওপরে তখন ওই শট । এমনকি লাঞ্চ ব্রেক , প্যাক আপের সময়ও আগাম
লিখে রাখা । প্রতিদিন ।
হিউমার বা নির্মল হাস্যরস , স্যাটায়ার বা
ব্যঙ্গরস / পরিহাস এবং সর্বোপরি উইট বা বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরসের পরিমিত ব্যবহার বারবার
এসেছে তাঁর ছবিতে, তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে , সংলাপে । ‘জন- অরণ্য’ ছবিতে সোমনাথকে কথা
প্রসঙ্গে নটবর মিত্তির জিজ্ঞেস করেন --- “কেমন দেখলেন ?” সোমনাথ --- “এমনিতে তো বেশ
ভদ্র বলেই মনে হয় ।“ নটবর ---- “আর ওমনিতে
?” অথবা, ‘পরশপাথর’ ছবির শেষের দিকে পুলিশ আধিকারিকের সেই সকৌতুক প্রশ্ন --- “তা ,
পেটের ভিতরে পাথরটা এখন কোথায় ? কোলনে, না
সেমিকোলনে !” ব্যক্তিগত জীবনেও সত্যজিৎ ছিলেন
খুব রসিক মানুষ । ‘অভিযান’ ছবির শুটিং চলছে । সে সময়ে ওয়াহিদা রহমানের রূপে – গুণে
– নাচে এবং সর্বোপরি অভিনয়ে , আসমুদ্রহিমাচল মাতোয়ারা । তাঁকে ঘিরে যে বাড়তি আগ্রহ
থাকবে , সেটাই স্বাভাবিক । একটি দৃশ্য গ্রহণের আগে সত্যজিতের চোখে পড়ল , ওয়াহিদা রহমানের
মুখের ওপর চুল এসে পড়ছে । ক্যামেরাম্যান সৌমেন্দু রায়কে ডেকে, ঠিক করে দিয়ে আসতে বললেন
স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে । তিনি অভিনেত্রীর দিকে খানিকটা এগিয়ে যেতেই, পাশ ফিরে মুচকি হেসে
সত্যজিৎ বললেন – “ওকে একটা চান্স দিলাম !”
‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’ ছবিতে গুপি – বাঘার
বড় বড় রসগোল্লা খাওয়ার দৃশ্য ছিল । শুটিঙে ব্যবহারের জন্য ময়দার বলের ওপর ছানা দিয়ে
গোটা দশেক রসগোল্লা তৈরি করা হয়েছিল । রবি ঘোষ ও তপেন চট্টোপাধ্যায়কে বলে দেওয়া হয়েছিল
ওপর ওপর কামড়াতে । তো , দৃশ্য গ্রহণের পর, দলে পেটুক বলে পরিচিত কামু মুখোপাধ্যায়ের
সঙ্গে সত্যজিতের একটু রসিকতা করতে ইচ্ছে হল । তিনি কামুবাবুকে ডেকে বললেন --- “কি কামু
, তুমি তো শুনেছি খুব খেতে পারো । একটা গোটা রসগোল্লা খাও দেখি !” কামুবাবু যেন এই
কথার অপেক্ষাতেই ছিলেন । বিলম্ব না করে একটা রসগোল্লা নিয়ে তিনি বড় করে কামড় বসালেন
এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পারলেন , কী ফাঁদে পা দিয়েছেন ! কিন্তু তিনিও কামু
মুখোপাধ্যায় ! সবার সামনে তাঁকে নিয়ে মজা করা যে খুব সহজ নয় , সেটা বুঝিয়ে দিতেই মনের
ভাব গোপন করে খুব সপ্রতিভভাবে , তাঁর প্রিয় মানিকদাকে বললেন --- “বুঝলেন দাদা , ভালই
করেছে । তবে এত বড় তো , তাই রসটা ভেতর পর্যন্ত যায়নি , মাঝখানটা শক্ত থেকে গেছে !”
এতক্ষণ খুব কষ্ট করে সবাই হাসি চেপে ছিলেন , এবার আর পারলেন না । অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন
সত্যজিৎ - সহ সক্কলে ! প্রসঙ্গত , ফেলুদার গল্পে আমরা ‘ডায়মণ্ডা’র উল্লেখ পাই । ডায়মন্ড
আকারের মণ্ডা , তাই ডায়মণ্ডা । লেখার সময় আদৌ কিন্তু এমন কোনও মিষ্টির অস্তিত্ব ছিল
না । এই মিষ্টির ধারণাটি সম্পূর্ণ ভাবে সত্যজিতের স্বকপোলপ্রসূত । তবে বেশ কয়েক বছর
আগে টিভিতে দেখেছি , কলকাতার এক বিখ্যাত মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান মিষ্টিটি তৈরি করে সন্দীপ
রায়কে খাইয়ে এসেছে ।
গুগাবাবার শুটিঙের সময় তপেনবাবু এবং সত্যজিৎ রায়ের একই ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল
রামপুরহাটে । সেই ঘরের ঠিক সামনের হলঘরে আরও অনেকের সঙ্গেই থাকতেন কামু মুখোপাধ্যায়
। একদিন রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে আলো নিভিয়ে পরিচালক শুয়ে পড়েছেন । এমন সময়ে দেখা গেল
, হামাগুড়ি দিয়ে একজন হলঘর থেকে তাঁর ঘরে ঢুকল । ছায়ামূর্তিটি মানিকবাবুর বিছানার পাশের
টেবিল থেকে কিছু একটা নিয়ে , ঠিক আগের জায়গায় সেটি রেখে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই
, সত্যজিৎ অন্ধকারের মধ্যেই গমগমে গলায় বলে উঠলেন --- “কি কামু , আমার জন্যে দু ‘একটা
আছে , না সবগুলোই মেরে দিলে ?” বমাল সমেত ধরা পড়লেন কামু মুখোপাধ্যায় । আসলে স্টকে
টান পড়াতে তিনি ঘরে ঢুকেছিলেন সত্যজিতের প্যাকেট থেকে সিগারেট সরাবেন বলে ! কথায় বলে
, শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ । বহুদিন পর দেখা হওয়াতে খুশি হয়ে কথাবার্তার পর সত্যজিৎ, বন্ধুস্থানীয়
‘অন্তর্জলি যাত্রা’র লেখক কমলকুমার মজুমদারকে একদিন বাড়িতে আসতে বললেন । কমলবাবু মিঠেকড়া
সুরে বললেন ---- “কী করে যাই বলুন , আপনার বাড়িতে যে বড্ড ভদ্রলোকের ভিড় !” পত্রপাঠ
জবাব এলো ---- “ঠিক আছে , কবে আসবেন বলুন । সেদিন না হয় কিছু ছোটলোক আনিয়ে রাখব !”
গুরুতর পরিস্থিতিতেও সত্যজিৎ বহুবার নিখুঁত
রসবোধ ও বরফ শীতল মস্তিষ্কের পরিচয় দিয়েছেন । একবার , নৃপতি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি
দৃশ্যগ্রহণের জন্য পরিচালক – সহ সবাই তৈরি হওয়ার পর দেখা গেল নৃপতিবাবুই হাওয়া । দীর্ঘক্ষণ
সবাইকে ঠায় বসিয়ে রেখে , দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার পরে তিনি যখন আবির্ভূত হলেন , তখন আর সোজা
হয়ে দাঁড়াবার অবস্থায় নেই । আকণ্ঠ মদ্যপান করে রয়েছেন । এভাবে তৈরি হয়ে বসে থাকা মানে
প্রযোজকের বহু টাকা ক্ষতি । স্বাভাবিকভাবেই সত্যজিৎ থম মেরে বসেছিলেন ফ্লোরের একপাশে
। নৃপতিবাবুর অবস্থা তাঁকে জানানোর পর , একটু চুপ করে থেকে বললেন --- “বসে থাকতে পারবে
তো ? – তাহলেই আমার শটটা হয়ে যাবে ।“ দেখা গেল , পারবেন । নৃপতিবাবুকে মেকআপ করিয়ে
ফ্লোরে এনে, একটি চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হল । দূর থেকে সত্যজিৎ সবটা লক্ষ্য করছিলেন ।
এবার এগিয়ে এসে নৃপতিবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন , ---- “একটু বসে থাকতে পারবেন তো ?” স্যালুট
করার ভঙ্গীতে অভিনেতা উত্তর দিলেন --- “ওয়ার্ক ইজ ওয়ার্ক ।“ সত্যজিৎ স্মিত হেসে ক্যামেরায়
গিয়ে বসলেন ।
ঋণ : ‘দেশ’ পত্রিকা ।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.