বকুনি
গরমকালে শিয়ালদা মেন লাইনের লোকাল ট্রেনে এই
ভিড়টা অসহ্য লাগে অনন্যর । আক্ষরিক অর্থেই ভিড় উপচে পড়া কামরায় মনুষ্যেতর প্রাণীদের
মত যাতায়াত করতে করতে , মন আর শরীর , দু’টোই বিদ্রোহ করে । কিন্তু প্রতিদিন অ্যাপ ক্যাব
ভাড়া করে ইছাপুর – শিয়ালদা নিত্যপাষণ্ডগিরি করাও তার মাসিক সাংসারিক বাজেটে পোষাবে
না । তাই ট্রেনের চার নম্বর সিটে কোনও মতে বসার চেষ্টা করতে করতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা
লোকটার কপাল থেকে ঝরে পড়া ঘাম , তার হাতের ওপর টুপ টুপ করে পড়তে থাকলেও বিরক্তি চেপে
চুপচাপ বসে থাকে ।
আবার এই অবস্থাতেও যাত্রীদের মধ্যে ঠাট্টা
– মশকরা চলে । কেউ কেউ সবাইকে অবাক করে দরাজ গলায় গান ধরেন । এবং কিছু আশ্চর্যজনক ঘটনাও
ঘটে , যা মনে স্থায়ী দাগ রেখে যায় । তেমনটাই ঘটল আজ । ত্রিশের কোঠার এক সম্ভ্রান্ত
দম্পতি সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে উঠেছেন কামরায় । কোনও মতে বসার জায়গা পেয়েছেন , কিন্তু
অফিস ফেরত যাত্রীদের এই দমবন্ধ করা ভিড়ে তৈরি হওয়া গুমোট ভাব সহ্য করতে না পেরে বাচ্চাটা
পরিত্রাহী কেঁদে চলেছে । ওর মা শত চেষ্টাতেও কোনওমতেই থামাতে পারছেন না । কেউ কেউ আহা – উহু করছে , কেউ বা বিরক্তি প্রকাশ
করছে । আশ্চর্যের ব্যাপার , বাচ্চাটার বাবাও সেই দলে । সমানে বিরক্তি প্রকাশ , আর দাঁত
খিঁচিয়ে স্ত্রীকে বাচ্চাটাকে চুপ করাতে বলা ছাড়া আর কিচ্ছু করছেন না । ভদ্রলোকের স্ত্রী
শুধু খ্যাঁকানি খেয়ে বারবার অসহায় চোখে তাকাচ্ছেন স্বামীর দিকে ।
অনেকের কাছে প্রতিদিনের এই নাটক যখন বেশ জমে
উঠেছে , তখন আচমকা অনন্যর ঠিক সামনে বসা মধ্যবয়স্ক মহিলা গর্জে উঠলেন । অনন্যর মনে
হল উনি নিশ্চিতভাবে কোনও স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ! গলা চড়িয়ে ওই ভদ্রমহিলার স্বামীকে
বললেন --- “বাবা হয়ে বুঝতে পারছ না গরমে ওর কষ্ট হচ্ছে , খিদে পেয়েছে । ওকে নিয়ে ফ্যানের
নীচে তো একটু দাঁড়াতেও পারো । তা না , সমানে খিট খিট করে যাচ্ছ । এই ভাই , হ্যাঁ তোমাকেই
বলছি , জানলার ধারের সিটটা মেয়েটাকে ছেড়ে দাও তো ।“ যাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলা ,
সে বিনা বাক্যব্যয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল বাধ্য ছেলের মত । যারা ই. এম. ইউ. লোকাল ট্রেনে
যাতায়াত করেন , তাঁরা জানেন, এই সিটটা ছেড়ে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয় । গরমকালে , যে দিকে
ট্রেন যাচ্ছে , সেদিকের জানলার ধারের সিটটা দখল করতে হয় ট্রেন স্টেশনে ঢোকার সময় ,
ধাক্কাধাক্কির মধ্যে , চলন্ত ট্রেনে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে উঠে । মাঝেমধ্যেই এটা
করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে । অঙ্গহানি বা প্রাণহানি হয় । তো, এবার সন্তানকে নিয়ে জানলার
দিকে একটু ঘুরে বসলেন বাচ্চাটার মা । মায়ের দুধ খেয়ে আর ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় বাচ্চাটা
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বিল্কুল চুপ করে গেল । মধ্যবয়স্কার মুখে তখন যুদ্ধ জয়ের তৃপ্তির
হাসি । আর অনন্য – সহ আশেপাশের যাত্রীদের চোখে তখন খেলা করছে অচেনা ওই ভদ্রমহিলার প্রতি
গভীর সমীহ । যার সাথে সম্ভবত আর কোনও দিন দেখা হবে না ।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.