ইতিহাসের অলিগলি
ফেলুদা
বলে --- জব নয় , জোব চার্নক । তো , সেই জোব চার্নকের সমাধি দেখতে একদিন রাজভবনের মূল
ফটক ছাড়িয়ে , আরও একটু এগিয়ে ঢুকেই পড়লাম সেন্ট জন’স চার্চে । এখানে স্বীকার করে নেওয়া
ভাল , যে কলকাতার পুরনো সমাধিস্থান ঘিরে আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘গোরস্থানে সাবধান’ পড়ার পর থেকে
। যাইহোক , ঢুকতে দশ টাকার টিকিট কাটতে হল , যে টাকা ব্যয় হবে গোটা কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে
থাকা এই ধরণের পুরাতাত্ত্বিক স্মারকগুলি সংরক্ষণে এবং কলকাতার দুঃস্থ শিশুদের কল্যাণে
। লম্বা লম্বা থামের উপর দাঁড়িয়ে থাকা চার্চটির চূড়া ছুঁচলো ধরণের । একে বোধহয় ইন্দো-গথিক
স্থাপত্যরীতি বলা হয় । গেট দিয়ে সোজাসুজি এগিয়ে গেলে ডানদিকে প্রথম বাঁকটির পরে , প্রথম
চোখে পড়ে লর্ড ব্রেবোর্নের সমাধি । এর ঠিক পিছনেই একই সারিতে কালানুক্রমিকভাবে এই চার্চের
বিভিন্ন পাদ্রিদের সমাধি । তার পাশেই কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার স্মরণে একটি নাতিদীর্ঘ
মিনার । এর ফলকে যদিও বলা হয়েছে , ঠিক এইখানেই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল , তথাপি
আদতে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য হল , এমন কিছু আদৌ ঘটেইনি । স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিংসও
এই মিথ্যেটা ধরতে পেরে আসল মিনারটি ভেঙে দেন । এখন যেটি দেখা যায় , সেটি অনেক পরে আবার
তৈরি হয়েছে বলেই কলকাতা-গবেষকেরা মনে করেন । আর একটু নাক বরাবর এগিয়ে গেলেই জোব চার্নকের
সমাধিমন্দির । বাংলা সিনেমায় এই জায়গাটা বহুবার দেখেছি , তাই খুব চেনা । কিন্তু যেটা
দেখিনি , সেটা হল এর ভেতরে চার্নকের সমাধিফলক । সেখানে লেখা ওঁর মৃত্যু হয়েছিল জানুয়ারি,
১৬৯২ খৃস্টাব্দে । কিন্তু ইতিহাসে যে পড়েছি , তারিখটা ১০ ই জানুয়ারি ১৬৯৩ ! কোনটা ঠিক
? ইতিহাসের শিক্ষক এক বন্ধু বলল – দু’টোই । তখন বছর মার্চ মাস থেকে গোনা হত । এর ঠিক
পিছনেই , চার্চের পিছনের গেটের পাশে যে সমাধিমন্দিরটি আছে , তার ফলক পড়ে জানা গেল,
এই পরিবারটিকে সাবেক কলকাতার আদি বাসিন্দা বা বলা ভাল প্রথম নথিভুক্ত ব্রিটিশ বাসিন্দা
মনে করা হয় । ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন --- “রাতে মশা দিনে মাছি / এই নিয়ে কলকাতায় আছি
।“ ঘুরতে ঘুরতে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম , সাবেক আর আধুনিক কলকাতার মধ্যে যোগসূত্র তৈরির
কাজটা দিনের বেলাতেও মশা ভালভাবেই পালন করছে ! চার্চের প্রার্থনাকক্ষের ঠিক পিছন দিকে
আছে লেডি ক্যানিং(লেডিকেনি খ্যাত)- এর সমাধি । যেন যিশুর চরণাশ্রিত । মৃত্যুর পরে লেডি
ক্যানিংকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল ব্যারাকপুরে , ভাইসরয় হাউসের কাছে , গঙ্গার পাশে তাঁরই
হাতে তৈরি বাগানে । পরে ব্যারাকপুরের সমাধিটির প্রতিরূপ অক্ষত রেখে দেহাবশেষ এখানে
নিয়ে আসা হয় । একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম ঘুরতে ঘুরতে যে , এই প্রাঙ্গণে সেকালের
ব্রিটিশ রাজন্যবর্গের বাইরে আর কারও ঠাঁই হয়নি । মৃত্যুর পরেও সুসভ্য ব্রিটিশ সমাজে
সামাজিক অবস্থান প্রদর্শনের ইচ্ছা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মত প্রবল ছিল , এ কথাটা
বুঝতে অসুবিধে হয়না । ভগবানের বাড়িতেও ফার্স্ট ক্লাস – সেকেন্ড ক্লাস ! গির্জার ভেতরটা
অলঙ্করণে দেখার মত । যিশুর মূর্তির পাশেই লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘দ্য লাস্ট সাপার’-
এর একটি অসাধারণ প্রতিরূপ আছে । তৈলচিত্রটি মনে রাখার মত । চোখ আটকে যায় গোটা হল জুড়ে
রঙিন কাচের কাজেও । বাইরে থেকে আসা আলোয় রঙিন কাচের ওপর ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবি দর্শককে
যেন বাইরের সদাব্যস্ত মহানগর থেকে দূরে কোনও অচেনা আনন্দলোকে নিয়ে যায় । দৃষ্টিনন্দন
শার্সির থেকে ভিতরে চোখ ফেরালে বহু পুরনো, একটি বৃহদাকার বাইবেল দেখা যায় । পাতাগুলো
খোলা , যেন কেউ পড়তে পড়তে এইমাত্র উঠে গেছে
। কনফেশন বক্সের কাছে দু’টি সোনালি দেবদূতের মূর্তি আছে । এতটাই জীবন্ত , যে মনে হয়
এখনই ডানা মেলে উড়ে যাবে । প্রার্থনাকক্ষ সংলগ্ন একটা ছোট ঘরে ঢুকেই চমকে গেলাম ! কাচের
শো- কেসের মধ্যে রাখা ওয়ারেন
হেস্টিংসের চেয়ার । গদির জরাজীর্ণ অবস্থা , তবু কেন যেন অদ্ভুত রোমাঞ্চ হচ্ছিল । এই
ঘরেই রাখা আছে বুক সমান সেকেলে বাতিদান , আছে সুদৃশ্য কাঠের ফ্রেমে হেস্টিংসের টেবল
ক্লক । আছে প্রাচীন কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের
পেন্সিল স্কেচ , তৈলচিত্র , ব্রিটিশ রাজপুরুষদের প্রতিকৃতি । কৌতূহল বাড়ায় বহু পুরনো
সিন্দুক , সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের স্ট্যান্ড থেকে ঝোলানো হ্যাঙ্গার । একটি সমাধিফলকে
খুঁজে পেলাম --- ‘INDOSTAN’ শব্দটি । এক ইংরেজি শিক্ষক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল
, সে সময়ে এই ধরণের ফলকগুলি লেখা হত মূলত ল্যাটিনে এবং দৈনন্দিন জীবনে এই ধরণের বহু
মিশ্র শব্দ ব্যবহারের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে । এক্ষেত্রে যেমন INDIA আর HINDUSTAN
– এর মিলিত রূপ এই শব্দটি । চার্চ থেকে বেরিয়ে , ওই ফুটপাত ধরে হেঁটে আসার সময় চোখে
পড়ল , প্রাচীন স্থাপত্যরীতিতে তৈরি একটি বিরাট এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাড়ির গায়ে লেখা
--- ‘ওয়েলেসলি প্লেস’ । সাহেব – বিবি – গোলামের কলকাতা দেখার একটা ছোট্ট বৃত্ত সম্পূর্ণ
হল যেন !






















































কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.