সম্প্রতি , বি জে পি নেতা
কৈলাস বিজয়বর্গীয় জানিয়েছেন যে ,
খাদ্যাভ্যাসে পোহা বা চিঁড়ে দেখে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী চিনে ফেলেছেন তিনি ।
বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস সাধারণ মানুষের খুব প্রিয় এই খাদ্যটিকে কিন্তু কখনও হতশ্রদ্ধা
করেনি । বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে বৈষ্ণবদের প্রিয় বাৎসরিক পার্বণ । ১৫১৬ সালের(১৪৩৮
শকাব্দ) সেই দিনটি ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল ত্রয়োদশী তিথি । গঙ্গা নদীপথে সেদিনের
পেনেটি এবং আজকের সোদপুর বা পানিহাটিতে এসে নদীর ধারেই একটি বটগাছের তলায় বসেছেন
চৈতন্যদেবের অন্যতম সহচর নিত্যানন্দ । সেই খবর পেয়ে ছুটে এলেন সপ্তগ্রামের
রাজকুমার রঘুনাথ দাস । আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়লেন তাঁর সামনে । বারবার অধ্যাত্মবোধের
অভাবের কথা বলে নিজেকে হীন প্রতিপন্ন করতে থাকলেন । রঘুনাথকে নিবৃত্ত করতে
নিত্যানন্দ তাঁকে এক মধুর দণ্ড দিলেন । নির্দেশ দিলেন উপস্থিত অগণিত ভক্তকে চিঁড়ে –
দই খাওয়াতে । গুরুর আদেশ শিরোধার্য করে রঘুনাথের উদ্যোগে এক এলাহি আয়োজন হল । ঘাটে
স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় অনেক ভক্ত প্রসাদ হাতে নেমে পড়লেন গঙ্গা নদীতেই । সমাজের
সমস্ত শ্রেণির মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে পরম তৃপ্ত নিত্যানন্দ রঘুনাথ
দাসকে নির্দেশ দিলেন এই উৎসব চালিয়ে যেতে । সেই শুরু । তারপর পাঁচশো বছরেরও বেশি
সময় ধরে , প্রতি বছর হয়ে চলেছে ‘পানিহাটি চিঁড়া উৎসব’ বা ‘দণ্ড মহোৎসব’ । বৈষ্ণবেরা
বিশ্বাস করেন , স্বয়ং চৈতন্যদেব যোগ দিয়েছিলেন এই উৎসবে । কথাপ্রসঙ্গে চৈতন্যদেব
রঘুনাথকে ‘মর্কট বৈরাগী’ হতে নিষেধ করেছিলেন । নিত্যানন্দ ও চৈতন্যদেব পরস্পরকে
চিঁড়ে – দই মাখা দলা খাইয়ে দিয়েছিলেন । এই উৎসব হয় প্রতিবছর জুন মাসে মহোৎসবতলা
ঘাটে । প্রসাদের উপকরণ নির্বাচনের বিষয়টিও সুচিন্তিত । এই উৎসব
গ্রীষ্মকালে হয় । তাই যাতে সবার পেট ঠাণ্ডা থাকে , সে কথা মনে রেখেই যে এই দু’টি
সহজলভ্য খাদ্যবস্তু বেছে নেওয়া হয়েছিল তা বুঝতে অসুবিধে হয় না । আর কথাতেই তো আছে
, ভুঁড়ি ঠাণ্ডা , তো মুড়ি(মাথা) ঠাণ্ডা ! প্রথম চিড়া – দই উৎসবের মতই প্রতিবছর এই
দিনে দু’টি মালসা ভোগ হয় । একটিতে থাকে কলা ও মিষ্টি দই দিয়ে মাখা চিঁড়ে ।
অন্যটিতে ক্ষীর , চাঁপা কলা , কর্পূর ও ঘন দুধ দিয়ে মাখা চিঁড়ে । এর ওপর দিয়ে সাজিয়ে
দেওয়া হয় সন্দেশ , মালপোয়া , কালো জাম এবং গুঞ্জা ফুলের মালা । কারণ চিঁড়ে – দই
উৎসবের দিন চৈতন্যদেব , রঘুনাথ দাসের গলায় নিজের হাতে গুঞ্জা ফুলের মালা পরিয়ে
দিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি । সনাতন গোস্বামীর পরলোক গমনের পর থেকে রঘুনাথ শুধু ঘোল
খেয়ে থাকতেন , রূপ গোস্বামী গত হওয়ার পর তা – ও ছেড়ে দিয়ে প্রায়োপবেশনের পথ বেছে
নেন । এই আত্মত্যাগ মনে রেখে উৎসবে কলা পাতার পাত্রে ঘোল নিবেদন করা হয় । ভোগের
শেষ পাতে থাকে টক লেবু , মধু , আদা এবং মৌরি । ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ – তে মহাপ্রভুর
অন্ত্যলীলা বর্ণনায় ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে আছে ---
“শুনি প্রভু কহে , চোরা
দিলি দরশন ।
আয় আয় আজি তোর করিব দণ্ডন
।। “
সে দণ্ড ছিল সমবেত
ভক্তদের মধ্যে চিঁড়ে – দই ফলাহার বিতরণ । সকলে ওই দিন শ্রীচৈতন্যের মহিমাকীর্তন
করেছিলেন । কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন ---
“এই তো কহিল নিত্যানন্দের
বিহার ।
চিড়া দধি মহোৎসব খ্যাত
নাম যার ।।“
এছাড়াও , ‘চৈতন্য ভাগবত’
, ‘গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া – ওয়েস্ট বেঙ্গল – টুয়েন্টি ফোর পরগনাজ’ , জয়ানন্দ বিরচিত
‘চৈতন্যমঙ্গল’ প্রভৃতি আকর গ্রন্থে এই উৎসবের সবিস্তার উল্লেখ পাওয়া যায় ।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ,
স্বামী বিবেকানন্দ , গিরীশ চন্দ্র ঘোষ , শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (শ্রীম) প্রমুখ
অনুগামীদের নিয়ে নিয়মিত এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতেন । তিনি শেষবার এসেছিলেন ১৮৮৫ সালে
। পরের বছর তিনি পরলোকগত হন । ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ এবং ‘রামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ – এ
এই ইতিহাসের সাক্ষ্য পাওয়া যায় ।
১৯৩৯ সালে এই ঘাটে এসেছেন
মোহনদাস করমচন্দ গান্ধীও । সেই ছবি আছে এই ঘাটে । ছবিতে তাঁর পিছনে বিধানচন্দ্র
রায় এবং শরৎচন্দ্র পণ্ডিত (দাদাঠাকুর)- কে দেখা যায় ।
এই ঘাট সংলগ্ন একটি মন্দিরে চৈতন্যদেবের পদচিহ্ন সংরক্ষিত আছে ।
এককথায়, হিন্দুদের অন্যতম
প্রিয় এই তীর্থক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চিঁড়ে নামক খাদ্যবস্তুটি । এই ইতিহাস মনে
রাখলে উগ্র হিন্দুত্বের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাবার আর কোনও উপায় থাকে না ।
এই ঘাটটি পানিহাটি –
কোন্নগর ফেরিঘাটের ঠিক পাশে । বি টি রোড ধরে আসলে পিয়ারলেস নগরের কাছে । অটো বা
টোটোতে যেতে মিনিট দশেক সময় লাগে । সোদপুর স্টেশন থেকেও এই ঘাটে অটো যাতায়াত করে ।
( ঋণ ঃ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও পানিহাটি পুরসভা )
https://sankhamanigoswami.blogspot.com/2020/10/pub-9792609886530610_89.html
https://images.app.goo.gl/4ZhA3AVdrJyKmAVa9



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.