“আনবে কটকি জুতো , মটকিতে ঘি এনো , জলপাইগুড়ি থেকে এনো কই জিয়োনো । “ এই ভরা বর্ষায় পাহাড়ি নদীতে মাছ ধরা দেখা ক্ষেত্র বিশেষে অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে । যাঁরা প্রাচীন বৈকুণ্ঠপুর , অধুনা জলপাইগুড়ি শহরে থাকেন বা যাতায়াত করেন তাঁরা নিশ্চয়ই এমন দৃশ্য দেখে থাকবেন । বোধহয় সময়টা এই সহস্রাব্দের শুরুর দিকে । শহরের কাছে তিস্তা ব্রিজে মাঝেমধ্যেই চলে যেতাম সাইকেল নিয়ে । আমাদের বাড়ি ছিল জলপাইগুড়ি শহরে , শিল্পসমিতি পাড়ায় । সেখান থেকে তিস্তা ব্রিজ মেরেকেটে দু’-তিন কিমি হবে । বর্ষাকালে এমনই একদিন দুর্ধর্ষ এক দৃশ্য দেখলাম । একেবারে লাইভ স্টান্টবাজি ! রুটিরুজির তাগিদে মানুষকে অনেকসময় এমন সব চূড়ান্ত বিপজ্জনক কাজ করতে হয় যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন । ব্রিজের ওপারে ময়নাগুড়ি , এপারে জলপাইগুড়ি । ব্রিজের মাঝ বরাবর, জলপাইগুড়ি শহরের দিকটাতে দেখি , ব্রিজের রেলিঙয়ের সাথে তিনটে কাছি বাঁধা শক্ত করে । কাছিগুলো নেমে গেছে বর্ষায় উত্তাল পাহাড়ি নদীটিতে । সামনে গিয়ে ফুটপাতে সাইকেল স্ট্যান্ড করে , নীচে তাকিয়ে যা দেখলাম , তাতে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল ! দেখি দু’টো কাছি একটা কলা গাছের ভেলার দু’প্রান্তে বাঁধা । আরেকটা কাছি একটা লোকের কোমরে বাঁধা । লোকটা ওই অবস্থায় খরস্রোতা তিস্তা নদীতে , ওই ভেলার উপরে দাঁড়িয়ে জাল ছুঁড়ে মাছ ধরছে । সহজেই অনুমেয়, কী অকল্পনীয় শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার কাজটা করতে । যা মাছ উঠছে তা একটা লোহার বালতিতে ভরে, নীচ থেকে বালতিতে বাঁধা দড়ি ধরে একটু নাড়াচ্ছে আর উপরে তাকাচ্ছে লোকটা । ওটাই সঙ্কেত । সঙ্গে সঙ্গে ব্রিজের ওপর দাঁড়ানো একটা বুড়ো মত লোক, কুয়োর বালতি তোলার কায়দায় সেটা টেনে তুলছে ব্রিজের উপরে । তারপর একটা বিরাট জল ভরা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির মধ্যে মাছগুলো ঢেলে দিচ্ছে । নীচে স্রোতের গর্জন আর উপরে হাঁড়ির ভেতরে মাছের খলবল করার শব্দে বেশ একটা বর্ষার সিম্ফনি তৈরি হচ্ছে । আমাদের পাতে যে বোরলি বা সোনালি বোয়াল পড়ে , তা ধরতে যে এভাবে জীবন বাজি রাখতে হয় , তা আমি আগে জানতাম না । বন্ধুদের কাছে শুনি, এখনও এভাবে মাছ ধরা হয় তিস্তায় । যে লোকটা ভেলার উপর দাঁড়িয়ে ছিল, তাঁকে কিন্তু একবারও বেসামাল হতে দেখিনি সেদিন । আলাপ করে জেনেছিলাম ওই যুবক, বৃদ্ধের ছেলে । দু’- তিন জন আগ্রহী ক্রেতা সঙ্গে সঙ্গে মাছ কিনে নিচ্ছেন চড়া দাম দিয়ে , এ দৃশ্যও একইসাথে দেখেছি । সে তো গেল মাছের দাম । জীবনের ঝুঁকির হিসেব কীভাবে হয়, কে জানে ।
আরেকবার, আমি আর এক বন্ধু তিস্তা ব্রিজের
ধারে স্পারের ওপর বসে আড্ডা দিচ্ছি বিকেলের দিকে । সামনে দিয়ে বড় বড় গাছের গুঁড়ি ,
ডাল , কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে অবিরত । সব কিছুরই গায়ে পলি লেপটে আছে । আর এই পলি মিশ্রিত
ঠাণ্ডা জলের খুব মিষ্টি একটা গন্ধে ম ম করছে চারদিক । সাথে ভেজা বাতাস । হঠাৎ দেখি
দুরন্ত তিস্তায় একটা ছাই রঙা পুরুষের দেহ মুখ ডোবা অবস্থায় হুউউউশ করে ভেসে চলে গেল
ঠিক আমাদের সামনে দিয়ে । গায়ে জামা – প্যান্ট লেপটে আছে পলিমাখা অবস্থায় । কী করণীয়,
তা-ই ভেবে আচমকা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম । বন্ধুটি সেদিন কোনওমতে আমাকে নিরস্ত করতে
পেরেছিল ।
মাধ্যমিকের পরে আরেক বর্ষায় এক বিকেলে
আমরা তিন বন্ধু মিলে শহরেই ডি. এফ. ও. – র বাংলোর উল্টোদিকের তিস্তার স্পারে বসে আড্ডা
মারছি । তখন বর্ষার সবে শুরু । নদী ফুলে – ফেঁপে ওঠেনি । অনেকটা চর তখনও জেগে আছে নদীর
বুকে । স্পারের কাছে হাঁটু ডোবা জল । সেটা পেরিয়ে চরে পৌঁছতে হবে । ততদিনে নদীর বুকে
কুয়োর মত গর্তের কথা শুনেছি , চোরাবালির কথা শুনেছি , কিন্তু দেখিনি । কী খেয়াল হল
, আমরা হঠাৎ ঠিক করলাম , সামনের ওই চরটাতে গিয়ে খানিক নাচানাচি করে আসব ! শুভস্য শীঘ্রম
ভেবে নেমে পড়লাম । চটি হাতে নিয়ে , হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট তুলে, অল্প স্রোত উপেক্ষা
করে পৌঁছে গেলাম চরে । পূর্বপরিকল্পনামাফিক সব হল । সূর্য ঢলতে শুরু করতেই খেয়াল হল
, ফিরতে হবে । এই প্রথম মনে হল চরটা যেন একটু ছোট হয়ে এসেছে । উপেক্ষা করে জলে নামলাম
। কনকনে ঠাণ্ডা জলে শরীরে শিহরণ খেলে গেল । জলের তাপমাত্রা পাল্টে যাওয়াতে বিপদের আঁচ
পেলাম । কিন্তু, আমরা যে নতুন যৌবনের দূত ! কাজেই সেটাকেও থোড়াই কেয়ার করে এগোলাম ।
একটু দূরে যাওয়ার পরেই বুঝলাম আস্তে আস্তে জলস্তর বাড়ছে । হাঁটু পেরিয়ে জল এখন কোমর
সমান । কোমরের ওপরে, স্রোতের নদীতে, জল উঠে গেলে আর ভারসাম্য বজায় রাখা যায় না , কে
যেন বলেছিল , মনে পড়ল । স্পার আর খুব বেশি দূরে নয় । আমাদের সাইকেলগুলোও আবছা দেখা
যাচ্ছে স্পারের মাথায় । কিন্তু ওই অব্দি পৌঁছতে পারব তো ? বাড়ি ফেরা হবে তো ! হৃৎপিণ্ড
তখন গলার কাছে উঠে এসেছে , বলাই বাহুল্য ! কোমর ছাপিয়ে জল উঠছে বুকের দিকে । এক বন্ধু
কাঠ কাঠ গলায় বলল – “তিন জনে হাত ধরে এগোলে , চট করে কেউ ভেসে যাব না ।“ তা-ই করা হল
। মনে মনে তখন ইষ্টনাম জপ করছি ! হঠাৎ মিরাকল ! জল বাড়া থামল । বরাতজোরে সে যাত্রায়
আমরা প্রাণে বেঁচে গেলাম । পরদিন কাগজে দেখলাম , পাহাড়ের দিকে ভারী বৃষ্টি হওয়ার জন্য
, জলস্তর অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় , গজলডোবায় তিস্তা ব্যারেজ থেকে জল ছাড়া হয়েছিল । হঠকারিতার
পরিণাম প্রাণঘাতী হতে পারত সেদিন । হয়নি যে, সে আমাদের সৌভাগ্য । তবে , সেদিন স্পারে
উঠে বোল্ডারের উপর ভেজা শরীরে চিৎপাত হয়ে শুয়ে , কিছুক্ষণ পর, আমরা তিন বন্ধু পরস্পরের
দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলাম , মনে আছে !
https://sankhamanigoswami.blogspot.com/2020/10/pub-


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.