কথায় বলে বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে । দুর্গা
দুর্গা বলে একদিন সকাল সকাল বেরিয়ে ই এম ইউ লোকাল ট্রেনে চেপে সোজা রানাঘাট স্টেশনে
এসে নামলাম । স্টেশনের বাইরে দোকানের সাইনবোর্ডে ঠিকানা লেখা – রথতলা , রানাঘাট , নদীয়া
। স্টেশন থেকে ম্যাজিক ভ্যানে করে চাপড়া বাজারে নামলাম । আসার পথে দু’টি জিনিস আলাদা
করে চোখে পড়ল--- ১) ফুলের খেত আর ২) কিছুদূর অন্তর অন্তর খেতে নাড়া পোড়ানোর ক্ষতি সম্পর্কে
সচেতনতা বাড়াতে সরকারি বিজ্ঞপ্তি । কাগজে দেখেছি এই নাড়া পোড়ানো দিল্লি , উত্তরপ্রদেশ
, হরিয়ানা , পঞ্জাবের ভয়ঙ্কর বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ । এ রাজ্যেও রাতে দূরপাল্লার ট্রেনে
যাতায়াতের সময় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার খেতের মাঝখানে নাড়া পোড়ানোর আগুন দেখেছি । যাইহোক
দেখেশুনে বুঝলাম , এই চাপড়া বাজারে চাষিরা তাঁদের ফসল পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ।
স্বাভাবিক ভাবেই গোটা এলাকা সরগরম । আমি ফুলের খেত দেখতে এসেছি জেনে এক খুচরো ফুল বিক্রেতা
বলে দিলেন , পুরাতন চাপড়া গ্রামের পুকুর পাড়ে যান , বাহারি ফুল দেখতে পাবেন । কিন্তু
সে জায়গায় পৌঁছে প্রথমেই একটু দমে গেলাম । একেবারে গ্রামের কেন্দ্রস্থলে, স্বর্গীয় নির্জনতা ভেঙে, তারস্বরে
ডি জে বক্স বাজাচ্ছে এক পিকনিক পার্টি । তাদেরকে পাশ কাটিয়ে আমি ফুল দেখতে এগিয়ে গেলাম
। তারপর প্রকৃতির অকৃত্রিম রূপ দেখে কাশ্মীর সম্বন্ধে আমির খস্রুর সেই বিখ্যাত স্বগতোক্তি মনে পড়ে গেল --- “গার ফিরদৌস
বারুয়ে জমিন অস্ত , হামিনঅস্ত , হামিনঅস্ত ।“ ---- ধরণীতে যদি স্বর্গ বলে কিছু থেকে
থাকে , তবে তা এখানেই , এখানেই । আমি পার্সি জানিনা । উদ্ধৃতিটা মনে থাকার একমাত্র
কারণ , ‘হামি’ শব্দটা ফিরে ফিরে আসা ! কিন্তু সত্যিই , কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক , কে
বলে তা বহুদূর । কাছেপিঠেই তো আছে স্বর্গছেঁড়া এক গ্রাম। সুধী বঙ্গজন, এখানে আর পিকনিক
, ডি জে বক্স আনবেন না । কিছু জায়গা থাক না নিজেদের মত । গ্রামে বিজ্ঞপ্তি দেখে জানলাম
, ২০১৫ সালে এই গ্রামটিকে নির্মল গ্রাম ঘোষণা করা হয়েছে । তাই আলপথ ধরে , অনভ্যস্ত
পায়ে , ভারসাম্য বজায় রাখতে রাখতে নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করা যায় । এই পরিবেশে দাঁড়িয়ে
যদি কারও ফুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে , তবে বুঝতে হবে , শুধু চেহারা ছাড়া মানুষের কোনও গুণই
তার মধ্যে নেই । এক চাষি ভাইকে দেখলাম , জমিতে বড় বড় চিনির দানার মত ইউরিয়া সার দিতে
। সেদিকে তাকাতে গিয়ে আমার পা চটি – সহ কাদায় ঢুকে গেল ! তা যাক , একটু মাটি লাগুক
শরীরে । মাটি থেকে বড্ড দূরে সরে গেছি ।
এবার ফেরার পালা । রাস্তায় চোখে পড়ল , চাপড়া
জুনিয়র হাই স্কুল । এখানে আসার সময় চাপড়া বাজারে দেখেছিলাম , বিন – এর একটা ছোটখাটো
পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন একজন ! সেই বিন নাইলনের বস্তায় বন্দী হচ্ছে , শহরে ছড়িয়ে
পড়বে বলে । চাপড়া গ্রামের ত্রিসীমানায় কিন্তু হোটেল – রেস্তরাঁ নেই । ও পর্ব স্টেশনের
বাইরেই সেরে আসতে হবে । ভাল ভাল হোটেল আছে অনেক , অল্প দামে উদরপূর্তি করার জন্য ।
গ্রামের ভিতর দিয়ে আসতে আসতে একটা বাড়ির গোবর দিয়ে নিকনো উঠোনের একপাশে বিরাট উঁচু
টাওয়ার , নন আয়োনাইজড রেডিয়েশনের সতর্কবাণী – সহ । আরেকটা বাড়ির উঠোনে মুরগির খাঁচার
ওপর মশারি টাঙানো । গ্রামের রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের বেঞ্চের ওপর ভাঁজ করে রাখা
খবরের কাগজ । যাঁর টোটোতে স্টেশনে ফিরলাম , তাঁরও ফুলের খেত আছে । আমার সাথেই বিরাট
ফুলের বস্তা নিয়ে এলেন , যাবেন মায়াপুর । এখানে যাতায়াতের বাহনগুলির নামও মজার – ম্যাজিক
ভ্যান , টুকটুকি ! আমি ০২-০২-২০২০ তারিখে গিয়েছিলাম । দেখলাম, ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মের
পাশেই একটা ছাদহীন মালগাড়ি দাঁড়িয়ে । উৎকট পচা গন্ধ আসছে গোটা গাড়িটা থেকে । এতটাই
, যে অনেক মেয়ে – মহিলার বিবমিষা জাগছে ।
বুঝলাম , আমার প্যারাডাইস লস্ট । চলো মন নিজ
নিকেতনে ।


















কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.