ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট
দুর্গা পুজোয় হেঁটে ঘুরতে বেরিয়ে কুড়ি – পঁচিশ
জন বন্ধু মিলে , দল বেঁধে রুবি বোর্ডিঙে খাওয়াটা বাঁধা ছিল প্রতিবার । কী একটা কথায়
সেবার আমি খুব হেসে উঠে দু’হাত ছড়িয়ে দিতেই ঘটে গেল বিপত্তি । উল্টোদিকে এক ভদ্রমহিলা
ছেলেকে পাশে নিয়ে বসে খাচ্ছিলেন । জলের গেলাস আমার উচ্ছ্বসিত হাতের ধাক্কায় গিয়ে পড়ল
তাঁর খাবার প্লেটে ! বলা বাহুল্য খাওয়ার দফারফা ! আর হাসি আচমকা থেমে গিয়ে আমি যথারীতি
কিংকর্তব্যবিমূঢ় । ততক্ষণে বেয়ারাকে ডেকে ওর ওই খাবারটাই আরেক প্লেট অর্ডার দেওয়া হয়ে
গেছে মা – ছেলের জন্য । সবার হতভম্ব ভাবটা কাটার আগেই ফিরে এসে , কাঠের চেয়ার টেনে
বসতে বসতে ও শুধু ভদ্রমহিলাকে বিনয়াবতার পাপোশ হয়ে বলল – “প্লিজ, কিছু মনে করবেন না
। ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্টালি হয়ে গেছে । উই বেগ ইওর পারডন । আপনাদের খাবার আসছে ।“
ভদ্রমহিলার ভীষণ ভাবে কুঞ্চিত ভ্রূ এতে খানিকটা সোজা হল । একটা বড় গোলমাল দানা বেঁধে
ওঠার আগেই মিটে গেল । আর আমি অল্পের জন্য সবার ঝাড় খাওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলাম সে
যাত্রায় । আমাদের বন্ধু অচ্যুত এমনই , প্রত্যুৎপন্নমতি ।
র্যাঞ্চো যেন কী বলত ? এক্সেলেন্স । উৎকর্ষে
মন দাও , সাফল্য আপ সে আপ আসবে । এ গল্প অবশ্য তার অনেক আগের , নয়ের দশকের শেষের দিকের
। অচ্যুতদের বাড়িতে আমাদের একটা সান্ধ্য আড্ডা , থুড়ি ঠেক ছিল । বাইরের ঘরে, এম. টিভিতে
ভেঙ্গা বয়েজের লাস্য কিংবা শুভা মুদ্গলের – ‘আব কে সাওন এয়সে বরসে’ চলতো , আর আমরা
পঙ্গপালের ঝাঁকের মত সামনের খাটে বসে গোগ্রাসে সেসব গিলতাম । আর খাটেরই আরেক প্রান্তে
, বুকের কাছে বালিশ নিয়ে আধশোয়া হয়ে, অচ্যুত সার্কিট বোর্ডের বই ঘাঁটত । প্র্যাক্টিকাল
খাতার মত দেখতে এমন এক একটা বই ওর হাতে ঘুরত , যার পাতার পর পাতা জুড়ে রয়েছে শুধু বিভিন্ন বৈদ্যুতিন যন্ত্রের সার্কিট বোর্ডের ছবি । আমার
সেগুলোকে একেবারে মানচিত্রের মত লাগত দেখতে । আর ওর অখণ্ড মনোযোগী তর্জনী এঁকে বেঁকে
ঘোরাফেরা করত পাতার মধ্যে । এরকম অপূর্ব একাকে কি সহ্য হয় সে বয়সে ! আমরা যারপরনাই
বিরক্ত হয়ে বলতাম --- “কী ছাইপাঁশ গিলছিস ? আব্বে, এদিকে তাকা । ব্ল্যাক মাম্বা আর
সাম্বা দেখ !“ ও স্মিত হেসে টিভির দিকে এক পলক তাকিয়েই ফের বইয়ে ডুবে যেত অনায়াসে
, কোনও কথা বলত না ।
“তখন তোমার একুশ বছর বোধহয় / আমি তখন অষ্টাদশী
ছোঁয়ায় ।“ প্রেম , উচ্চ মাধ্যমিকে বায়ো সায়েন্স , এবং তারপর কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পাস
গ্র্যাজুয়েট । আর, এসবের ফাঁকে ফাঁকে যুব কল্যাণ বিভাগের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে
একের পর এক কোর্স করা --- অচ্যুতের জীবনটা তখনও সমবয়সী আর পাঁচজনের থেকে খুব একটা আলাদা
ছিল না । ও পড়াশোনায় ভাল ছিল , কিন্তু আহামরি নয় । আরও কিছুদিন পরের কথা । আমরা তখন
ম্যারাথন আড্ডা মারছি , নাটক করছি , লিটল ম্যাগ বের করছি , কিংবা নিখাদ সমাজসেবা করছি
পরম উৎসাহে । আর ও, বাড়ির ভিতরে উঠোনের দিকে এক কোণায়, নিজের মত করে একখানা টিনের চাল
দেওয়া বেড়ার ঘর বানিয়ে নিয়েছে স্বোপার্জিত অর্থে । সে ঘরে বেড়ার দরজা ঠেলে ঢুকতে হয়
। ওদের একতলা পাকা বাড়ির বাকি সদস্যদের সেখানে খুব প্রয়োজন ছাড়া , অলিখিত ভাবে প্রবেশ
নিষেধ । সেখানে তখন ও বাড়ির ভিতর থেকে টেনে নিয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ । ওই ছাপরা ঘরটাই
হয়ে উঠল ওর কর্মশালা । ঘরে ঢুকলেই চোখে পড়ত এলোমেলো চেয়ার – টেবিল , ঘরময় ছড়ান-ছিটান
বিভিন্ন যন্ত্রাংশ , টিভি , টেপ রেকর্ডার , মিউজিক সিস্টেম ইত্যাদি । ও লোকের কাছ থেকে
চেয়ে চেয়ে এনে ওগুলো ঠিক করে দিত । যেচে উপকার করতে গেলে যা হয় , অনেক ক্ষেত্রে সেটাই হত । বহু লোক আপাতদৃষ্টিতে ওর ভালোমানুষির
সুযোগ নিত । কাজের উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও হয় একেবারেই পেত না , নয়ত পেত নামমাত্র । এ
নিয়ে আমরা ওকে খুব প্যাক দিতাম । তখন আমাদের ‘বিভিন্ন’ প্রয়োজনে বেশ খানিকটা পকেট মানি
লাগার শুরুর বয়স । ও তার ব্যতিক্রম ছিল না , বলা বাহুল্য । আমরা প্রায়ই বিরক্ত হয়ে
ওকে খোঁচাতাম --- “কী গর্দভ রে তুই । লোকে তোকে দিয়ে বিনে পয়সায় খাটিয়ে নেয় , আর তুইও
বোকার মত বেগার খেটে মরিস , কিচ্ছু বলিস না । তোর দ্বারা কিস্যু হবে না ।“ শেষের বাক্যটা
আমাদেরকে বাধ্যতামূলক ভাবে প্রতিনিয়ত শুনতে হত । তাই নিজেরাও অন্যেকে শুনিয়ে দিতাম
একটু সুযোগ পেলেই । ও কিন্তু উত্তরে যথারীতি শুধু হাসত , ভাল – মন্দ কিছুই বলত না ।
আড্ডার সময়টা প্রায় বাদ দিয়ে ইতিমধ্যে অচ্যুত
আরেকটা কাজ নিয়মিত করা শুরু করেছিল । বিভিন্ন বৈদ্যুতিন যন্ত্রের যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়
যে সব দোকানে , সেই দোকানের মালিকেরা তখন অধিকাংশ সময়েই , হয় দিল্লি , নয়ত কলকাতার
চাঁদনি মার্কেট থেকে দল বেঁধে , ট্রেনের কামরা বোঝাই করে, সেইসব মালপত্র নিয়ে আসতেন
আমাদের মফসসল শহরে, জলপাইগুড়িতে । কিন্তু তারপর, অত জিনিসের মধ্যে থেকে তো দেখে নিতে
হবে , কোনটা ঠিক আছে , কোনটা নেই । ধরেই রাখতে হয়, যাতায়াতের পথে অতি স্পর্শকাতর যন্ত্রগুলির
অন্তত দশ শতাংশ ভোগে যাবে , থুড়ি খারাপ বেরোবে । আর খারাপ জিনিস লোকে কিনে নিয়ে গেলে
দোকানের সুনামের বারোটা বেজে যাবে । এত্ত জিনিসের মধ্যে এই ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজটা ,
--- ইংরেজিতে যাকে বলে একটা ‘ম্যামথ টাস্ক’ । যারা করেন তারা বিলক্ষণ জানেন এটা কতখানি
ধৈর্যের কাজ , সময়সাপেক্ষ কাজ , এবং সর্বোপরি ঠাণ্ডা মাথার কাজ । এই বিরাট দায়িত্বপূর্ণ
কাজটা অচ্যুত যেচে বিভিন্ন যন্ত্রাংশের দোকানে ঘুরে ঘুরে করা শুরু করল । অল্প পয়সায়
এ কাজ করার লোক আর কে পায় ! ফলে অচিরেই ওর কদর বাড়ল এবং ও কাজটার মধ্যে একেবারে ডুবে
গেল । বাড়িতে থাকলে অচ্যুত তখন নিজের ঘুপচি কাজের ঘরে , আর বাড়ির বাইরে থাকলে, দোকান
ঘরের মেঝেতে , মাথা গুঁজে যন্ত্রাংশে মগ্ন । আমরা সেখানে গিয়েই হানা দিয়েছি কয়েকবার
, কিন্তু হু –হাঁ-এর বেশি উত্তর পাইনি । স্বাভাবিকভাবেই
ওর জমে ক্ষীর হয়ে ওঠা প্রেমটা কেটে গেল । তারপর আস্তে আস্তে আমাদের সাথে যোগাযোগটাও
। আমাদের রাস্তা যে আলাদা হয়ে গেছে, সেটা বেশ অনুভব করতে পারছিলাম । বুঝতে পারছিলাম,
জীবন নামে আমাদের সামনের বিরাট সমুদ্রটায় পাড়ি দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে উঠেপড়ে
লেগেছে অচ্যুত । ওর হাতে কম্পাস , লক্ষ্য স্থির । ঝড় আসবে , কিন্তু ও দিকভ্রষ্ট হবে
না ।
এরপর দীর্ঘদিন কোনও দেখা – সাক্ষাৎ
নেই । ওর কথা প্রায় ভুলেই গেছি এবং সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে
পড়ছে একটু একটু করে , এমন একটা সময়ে, হঠাৎ আমাকে এবং আরও অনেককে একইসাথে ভীষণ চমকে
দিয়ে ফেসবুকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল ওর নামে , সঙ্গের ছবিটার সাথেও ওর মিল আছে
। গড়নটা একই আছে , কিন্তু জেল্লা বেড়েছে । শুধু মোম মসৃণ অচ্যুতের মুখে সেই চেনা গোঁফটা
হাওয়া । দিব্যি অনুমান করা যায়, খাসা আছে । একসেপ্ট করার পর স্মাইলির সাথে একটা ছোট্ট
মেসেজ ঢুকল – “কেমন আছিস ?” যথোচিত সম্ভাষণ পর্বের খানিকক্ষণ পরে জানা গেল, বাবু এখন
আমেরিকায় থাকেন ! সে এখন এক বহুজাতিক সফটওয়্যার – হার্ডওয়্যার প্রস্তুতকারী সংস্থার
মস্ত বড় চাকুরে । ওখানকার মেয়ে বিয়ে করে নাগরিকত্ব পেয়েছে । ও বছরে দু’বার করে দেশে
এলে আমরা , পুরনো বন্ধুরা মিলে ঘুরতে বেরোই , সঙ্গিনী- পোলাপান ছাড়া । বেশিরভাগ সময়তেই
ট্রেক করতে যাই কোথাও । আমাদের মত প্রতি মুহূর্তে কী করছি, কোথায় করছি , কাদের সাথে
করছি এবং কী করছিনা , সেসব লিখে বা ছবি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস আপডেট দেওয়ার
ব্যাপারে ওর কোম্পানির কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে । ওতে নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থার লোকেরা
সমস্ত গোপন ব্যবসায়িক খবর আগাম পেয়ে যায় লোক লাগিয়ে , যাতে ব্যবসার বিরাট ক্ষতি । এ
তো ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ । যাক গে যাক , আমাদের তো আর সেসবের বালাই নেই ! তাই
আমরা ছবি- সহ সবিস্তারে ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখে ওকে ট্যাগ করে ঘোরার গ্রুপে পোস্ট করে
দিই । ভ্রমণবৃত্তান্তের এখন হেব্বি ডিম্যান্ড । পকেটে পয়সা থাকলেই এখন উঠল ঝোলা , চলল
ভোলা । আর না থাকলে, ঘরে বসে মানসভ্রমণই সই , দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাকে বলে । টু
কে , থ্রি কে লাইক , কমেন্ট আসে আমাদের পোস্টে । আমাদের বন্ধুত্বের গল্প হাতে হাতে
শেয়ার হয় । খারাপ কী । কিন্তু এমন গল্পেরও আগের একটা গল্প তো থাকে সবার জীবনে । সেটা
সবাই জানেন না । জানতেও চান না । জীবনটা যে একটা উদযাপনের মাঝখান থেকে শুরু হয়না ,
সেটা তাঁদের জানাতেই এই গৌরচন্দ্রিকা ।
Short story
https://g.co/kgs/vwjJTa
ছোটগল্প
অধ্যবসায়ের গল্প
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা ছোটগল্প

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.