বাঙালির ভ্রমণ
বাঙালি ঘুরতে ভালবাসে । ঘোরাতেও ভালবাসে অবশ্য । মাস পয়লায় মাইনে
না পেয়ে ঘুরতে হলে মুখ ব্যাজার নয়ত কোম্পানি বা সরকারের গুষ্ঠির ষষ্ঠীপুজো করা । আর
হোম ডেলিভারির টাকা , মুদির দোকানের খাতায় বাকি থাকা টাকার বেলায় আজ নয় কাল , কাল নয়
পরশু । পাড়ায় চাঁদা দেওয়ার বেলায় পকেটখালির জমিদার আর বেড়াতে গিয়ে খরচা দেদার । সারা
বছর বাঙালি ভ্রমণ-সাহিত্য পড়বে , ভ্রমণ বিষয়ক লেখার পাতা উল্টাবে আর বেড়াতে গিয়ে ছানাপোনার
সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ল্যাজেগোবরে হবে , নয়ত পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে
ভুলভাল বকবে ।
কিছু বাঙালি বেড়ানোর প্ল্যান করলে আগে
খোঁজ নেবে কোথায় ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অতিথিশালা আছে । পাঁচ মাস আগে থেকে ঠিক অনুমতি
ম্যানেজ করবে । ঠিক সময়ে গিয়ে, চিঠি নিয়ে সেই আশ্রমে হাজির হবে সপরিবারে । আশ্রমের
বাইরে প্রচুর ফুর্তি করবে , খাবেদাবে , কেনাকাটা করবে , খরচ করবে খোলা হাতে । আর বিদায়
নেওয়ার বেলায় যা ডোনেশন দেবে , তাতে একবেলায় হোটেলে দু’জনের ভাত খাওয়ার খরচও ওঠে না
! ঘুরতে বেরিয়ে বাঙালিরা ট্রেনে যাতায়াতের সময় রাত আড়াইটেয় চা খাবে আর বাথরুমে গিয়ে
সিগারেট টানবে । কন্ডাক্টেড ট্যুরে ঘুরতে বেরিয়ে বাসে সামনের দিকেই বসবে জানলার পাশে
, কোনও আপস করবে না । দার্জিলিং বেড়াতে গেলেও কে জানে কেন শুদ্ধ হিন্দিতে কথা বলবে
! যেমন – “আপনাদের এখানে কী ভাত, মানে রাইস পাওয়া যাতা হ্যায় ?” যেখানেই বেড়াতে যাক
বাঙালি , খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মত করে বাংলা খবরের কাগজ খুঁজবে , আর সেটা হাতে পেলেই
--- আহা , কী আনন্দ ! পেট পাতলা বলে খ্যাত বং-দের বেড়াতে গেলে পেট ছাড়বেই জানা কথা
। সেই কারণেই বাঙালিরা নিজেদের সাথে মুঠো মুঠো এন্টেরোকুইনল আর অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট
রাখবে । আর হ্যাঁ , টিসু পেপার সঙ্গে নেবেই ! দক্ষিণ এবং বাম হস্তের কাজ সারাদিন পরপর
চলতেই থাকবে কিনা !
বেড়াতে বেরিয়ে ডিজিটাল ক্যামেরা ও মোবাইলে স্ফীতোদর বাঙালি বাবু ও বিবি পটাপট
ছবি তুলবেন আনাড়ি হাতে , যেগুলির অধিকাংশেরই ভাগ্যে অনতিবিলম্বে ডিলিট প্রাপ্তি ঘটবে
। কোন মহাপুরুষ যেন এই জাতটাকে শিখিয়ে গিয়েছিলেন যে , ঘুরতে বেরিয়ে মন খারাপ (প্রকাশ)
করতে নেই , সেই থেকে বেড়ানোর অ্যালবামে সব বাঙালি প্রাণপণে হাসিমুখ । তিনটে ব্যাগ নিয়ে
বেরোলে বাড়ি ফিরবে আরও তিনটে ভর্তি করে । তিন মাস আগে টিকিট কাটলেও অধিকাংশই কাটবে
এজেন্টদের কাছ থেকে , লাইনে দাঁড়াবে না কষ্ট করে । দক্ষিণ ভারত গেলে পাউরুটি খেতে গেলেও
বাঙালি বলবে – এঃ , বড্ড নারকেল তেলের গন্ধ ! পুরীতে গিয়ে চিংড়ির মালাইকারি চেটেপুটে
খেয়ে বলবে , নারকেলটা দু’দিন আগে বাটা , খুঁত ধরতে হবে না ! প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মোহিত
হলে , রবি ঠাকুরের গান গাইবে গুনে গুনে ঠিক দু’লাইন , কারণ তারপর আর মনে নেই !
বাঙালি ঘুরতে গেলেই অন্যের সাথে গায়ে
পড়ে আলাপ জমাবে , টিপে টিপে টুথপেস্ট বের করার মত হাঁড়ির খবর জানবে । জানাবে কম কিংবা
বানিয়ে বানিয়ে , ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নিজেদের কথা বলবে । তারপর হঠাৎ কোনও বিপদে পড়লে , সদ্য
পরিচিত মানুষটিকে ছেড়ে সবার আগে মানে মানে কেটে পড়বে । ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে
আর বাঙালি ঘুরতে গেলেও রাজনীতি চর্চা আর পদে পদে রাজনীতি করার বদভ্যাস ছাড়তে পারে না
। এ রাজ্যের বাইরের রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহ আর জ্ঞানগম্যি দু’টোই কম , আর আন্তর্জাতিক
হওয়ার তো প্রশ্নই নেই । ফলে বি জে পি হলে তৃণমূলের মুণ্ডপাত , না হলে উল্টোটা ! যে
লোক এমনিতে অফিসে বেলা বারোটায় ঢুকে তিনটেতেই টা টা গুডবাই , সেও ঘুরতে বেরিয়ে ওয়ার্ক
কালচার নিয়ে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা দেবে । আর দু’মিনিট পরপর ছবি-সহ স্ট্যাটাস আপডেট দেবে
ফেসবুকে --- ফিলিং ওয়ান্ডারফুল অ্যাট অমুক প্লেস উইথ থাউজেন্ড আদার্স !
দেশ(কিংবা বিদেশ) দেখতে বেরিয়ে বাড়ির চৌকাঠের
বাইরে পা রাখলেই কেন কে জানে বাঙালিবাবুরা নিজেদের হঠাৎ-রাজা ভাবতে শুরু করেন এবং চান
প্রতি মুহূর্তেই আশপাশের লোকেরা যেন তাঁর সাথে করজোড়ে হেঁ হেঁ করে কথা বলেন । যেন বাবুটি
সাক্ষাৎ পরিব্রাজক হিউ-এন-সাং-এর ব্রাদার-ইন-ল ! তবু এমনটাই চলছে , চলবে । কারণ ‘দুনিয়ার
বাঙালি এক হও’ মঞ্চ যদি একদিন সকালে আচমকা ঘোষণা করে , যে এই করোনা-কালে ঘুরে-বেড়িয়ে
পয়সা উড়িয়ে ক্ষতি বই লাভ নেই কোনও , কাল থেকে ভ্রমণ-বনধ --- তা হলে দেশ-বিদেশের পর্যটন
ব্যবসা আরও কতটা মার খাবে , তা আগাম বলার জন্য নস্ট্রাডামুস হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই
।
https://sankhamanigoswami.blogspot.com/2020/11/pub-9792609886530610.html



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.