জরুরি বিভাগ
আমি রাপ্তী । মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগে
আজ আমার এক মাস পূর্ণ হল । আমাদের কাজে হাতেকলমে শেখাটাই আসল । আর সেই কাজ করতে গিয়ে
বিচিত্র সব অভিজ্ঞতাও হয় আমাদের । ধারাবাহিকভাবে সবগুলো নিয়ে লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে
যাবে । তাই আপাতত আজকের কথা বলি । দু’টো কেস মনে স্থায়ী দাগ কেটে যাওয়ার মত । ট্রলিতে
নাইটি পরা , মোটা মত এক সধবা মধ্যবয়স্ক মহিলাকে রেখে , একটা লোক তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল
। দু’বার এসে হাতে টিকিট নিয়ে আমাকে দেখার জন্য বলেছে । সময় পাইনি । সকালবেলার দিকটা
বড্ড চাপ থাকে । দম ফেলার ফুরসত পাওয়া যায় না । অন্য এক সংকটজনক রোগীর কাছে ছিলাম ।
একটু পরে লোকটা আমার পিছু নিয়ে আবার সেখানে এল । ততক্ষণে সে ট্রলিটা নিয়ে আমাদের কিউবিকলের
কাছে রেখেছে । সম্ভবত অন্য জুনিয়র ডাক্তারদেরকেও ডেকেছে , পায়নি । সবাই রোগীর চাপে
অসম্ভব ব্যস্ত । আমরা না চাইলেও একটু অপেক্ষা করতেই হয় , কিছু করার থাকেনা । এবার কাজ
শেষ করে ভদ্রমহিলাকে দেখার জন্য এগোলাম । দূর থেকে দেখছি ওনার হাঁপ ধরেছে । অ্যাপ্রনের
পকেট থেকে পালস অক্সিমিটারটা বের করে ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মহিলা ডুকরে কেঁদে উঠলেন
হঠাৎ করে । কাতরাতে কাতরাতে ডান পায়ের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বললেন --- “আর পারছিনা
দিদি , আর সহ্য করতে পারছিনা ।“ মহিলার গোড়ালির কাছটায় একটা আধময়লা ন্যাকড়া আলতোভাবে
জড়ানো । তার চারপাশটা পেকে, ফুলে উঠেছে । ন্যাকড়াটা খুলতেই আমার অন্নপ্রাশনের ভাত মুখে
উঠে আসার জোগাড় । ওই জায়গাটায় হাতের তালুর মাপের একটা গোল গর্ত , তারমধ্যে কিলবিল করছে
অসংখ্য জ্যান্ত পোকা , আমরা যাকে ‘ম্যাগট’ বলি ডাক্তারি পরিভাষায় । ডাক্তারদের লজ্জা
– ঘেন্না – ভয় বিসর্জন দিতে হয় । স্যরেরা বারবার আমাদের এই কথাটা মনে করিয়ে দেন । তবু
কয়েক মুহূর্তের জন্য, বমি এসে যাওয়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম । তারপর মুখ দিয়ে
নিজের অজান্তেই বেরিয়ে গেল --- “এই অবস্থায় ফেলে রেখেছেন ! জায়গাটা পচে গেছে , এটুকু
বোঝেন না ?“ মহিলার পাশে থাকা লোকটি , তাঁর স্বামী বলে পরিচয় দিয়ে , নানা অজুহাত দিচ্ছিল
, অবান্তর কথা বলে চলছিল । আর অসহনীয় যন্ত্রণায় কাঁদতে থাকা মহিলাকে দেখে আমি ভাবছিলাম
, মানুষ এত সহ্যশক্তি পায় কোথা থেকে ! সার্জারি বিভাগের এক দাদাকে ডেকে দেখালাম । তিনি
অবস্থা দেখে আঁতকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে টিকিটে সার্জারি বিভাগে রেফার করে দিলেন । কোন দিক
দিয়ে , কীভাবে যেতে হবে , তা-ও বলে দিলেন । তারপর লোকটিকে শুধু বললেন ---- “তাড়াতাড়ি
যাও , আর দেরী করোনা । গ্যাংগ্রিন স্টার্ট করেছে । এরপর হাঁটু পর্যন্ত বাদ দিতে হবে
।“ ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল , এই লোকটিই মহিলার স্বামী , এর নামেই মহিলা সিঁদুর পড়েন ।
দ্বিতীয় ঘটনাটা একইসাথে ভীষণ করুণ এবং কিছুটা
মজারও , আমাদের পেশার অভ্যস্ত চোখে । একটা বুড়ো মত লোক আমার আশপাশে ঘুরছিল , টিকিট
আর একটা ই. সি. জি. রিপোর্ট নিয়ে । ই. সি. জি. গ্রাফটা দু’হাত দিয়ে টান করতে করতে
, সেদিকেই চোখ রেখে অভ্যেসবশত জিজ্ঞেস করলাম --- “রোগী কে ?” এরপর দু’টো ব্যাপার একসঙ্গে
ঘটলো । গ্রাফের শুরুতেই আমার চোখ আটকে গেল । ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে । আর একই
সঙ্গে বুড়ো মত লোকটা বলল --- “আমিই রোগী , দিদি ।“ নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত করে বললাম
--- “বাবা , তোমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে । ঘুরে বেড়িও না । চলো, শোও গিয়ে তাড়াতাড়ি ।“
বুড়োবুড়ি একাই এসেছে , সঙ্গে ট্রলি ঠেলার মতও কেউ নেই । ওনাকে কার্ডিওলজিতে রেফার করা
হল । জানিনা , এত বড় এলাকা ঠিকঠাক চিনে কতক্ষণে পৌঁছল , অথবা পৌঁছল না । দিনলিপিতে
লিখতে বাধা নেই , সাধারণ মানুষের জীবন বড় সস্তা এদেশে ।
----------------------
https://sankhamanigoswami.blogspot.com/2020/11/pub-9792609886530610_32.html

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Don't forget to like, comment, share and subscribe to my Blog. Thank you.